আলাদিনের দৈত্য

তিনি একটু দেরিতে ফোঁটা ফুল। যখন পাকিস্তান ক্রিকেট শেষের দিকে রান তুলতে পারার মত একজন পাওয়ার হিটার খুঁজে ফিরছিল – তখন তিনি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন – কে জানে। আবার যখন আসলেন, তখন নিজেকে মেলে ধরতে নিলেন বিস্তর সময়।

তবে, এবার যখন আসিফ আলী নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন, তখন বারবার প্রমাণ করেই যাচ্ছেন নিজেকে। প্রতিটা ইনিংস দিয়ে তিনি যেন বার বার বলতে চাচ্ছেন – অসম্ভবকে সম্ভব করাই আসিফ আলীর কাজ।

কি সেই অসম্ভব? পাকিস্তানকে জিতিয়েছেন ভারতের বিপক্ষে। তাও এমন একটা সময় যখন দুই ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ২৬ রান। পাকিস্তান আসিফের

তবে, অসম্ভবকে সম্ভব করা আসিফ আলীর জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এক ওভারে চারটা ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের ইনিংসের ১৯ তম ওভার। এই ওভার শুরু হওয়ার আগে পাকিস্তান ১২ বল হাতে রেখে জয়ের থেকে ২৪ রান দূরে।

সেদিন, মানে বিশ্বকাপের মঞ্চে ১৮ তম ওভারে মাত্র দুই রান  হজম করে আফগানিস্তানের নাভিন উল হক ফেরান অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান শোয়েব মালিককে। ম্যাচের স্পষ্ট ফেবারিট তখন পাকিস্তান। ঠিক সেই সময় আফগানদের সম্ভাবনা ও স্বপ্নের আগুনে পানি ঢেলে দেন আসিফ আলী, পাকিস্তানের নতুন দিনের নায়ক।

রহস্যটা কি? আসিফ আলী বলেন, ‘১৯ তম ওভারে আমি অনের বাউন্ডারিটা টার্গেট করছিলাম। কারণ ওটা ছোট। তবে, ওরাট ওয়াইড ডেলিভারি করল। তখন আসলে বড় বাউন্ডারির বড় ছক্কার দিকে না এগিয়ে কোনো উপায় ছিল না। ওভাবে আসলে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে, যেসব তুলে মারার বল পেয়েছি, মেরেছি।’

দুই ওভার আগেও জয়টা যেখানে ছিল প্রায় অসম্ভব, সেখানে এক ওভারের মধ্যেই পাকিস্তানকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গেলেন আসিফ আলী।

পাকিস্তানের জন্য এই বিশ্বকাপে আসিফ আলী যেন আলাদিনের সেই চেরাগের দৈত্য। যেকোনো অসম্ভব কোনো স্বপ্নকেই তিনি বাস্তবায়ন করতে জানেন। টুইটারেও তিনি যেন চেরাগের সেই দৈত্যর মতই বললেন, ‘ওউর কই হুকুম পাকিস্তান?’ অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায়, ‘আর কোনো আদেশ, পাকিস্তান?’

পরক্ষণেই আবার বলেন, ‘কঠিন সময়ে যারা আমার পাশে ছিলেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ!’ হ্যাঁ, ছক্কার অনন্য দক্ষতা দেখিয়ে ইতিহাস গড়া আসিফ আলী অল্প ক’দিন আগেই কাটিয়েছেন ভয়াবহ দুসময়।

মূলত ‘লেট ইনিংস স্লগার’ হিসেবেই একাদশে ঠাই হয়েছে আসিফের। তবে, তাঁর ব্যাটিংয়ে সেই পরিচয়ের ছাপ ছিল সামান্যই। সাম্প্রতিক অতীতেই এই আসিফ আলী তাঁর ব্যাটিং অ্যাপ্রোচের জন্য বেশ সমালোচিত হয়েছেন।

বিশেষ করে তাঁর ‘হিট অ্যান্ড মিস’ দর্শনের জন্য পাকিস্তানের দর্শকদের চক্ষুশ্যূলে পরিণত হন দ্রুতই। স্যোশাল মিডিয়ায় তিনি ছিলেন দর্শকদের সহজ শিকার। বিস্তর ট্রল হত তাঁকে নিয়ে। শুধু দর্শক নয়, পাকিস্তানের গণমাধ্যমও ছিল আসিফের সমালোচনায় সরব।

আসিফ বলেন, ‘শেষ সিরিজটায় (দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে) আমাকে খেলতে হয়েছে মিডল অর্ডারে। আমি ব্যাট করেছি ছয় নম্বরে। এটা আসলে খুবই ট্রিকি একটা পজিশন। যারা পরিসংখ্যান নিয়ে বেশি ভাবেন তাঁরা শুধু দেখবেন তিন ইনিংসে আমি ১০ রান করেছি। কিন্তু, কেউ দেখবে না যে আমি প্রতিটা ম্যাচে শেষ ওভারের তিন-চারটা বল খেলার সুযোগ পেয়েছি মাত্র।’

তবে, এবার সমালোচকদের মুখের ‍ওপর জবাব দিতে পেরেছেন আসিফ। এক ম্যাচ নয় – টানা দুই ম্যাচে। সমালোচকদের এখন বাধ্য হয়েই নিজেদের কথা হজম করে ফেলতে হয়েছে। এর জন্য পাকিস্তানের টিম ম্যানেজমেন্টের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। দিনের পর দিনে এক অংকের ঘরে আউট হয়ে যাওয়ার পরও আসিফের ওপর তাঁরা ভরসা করে গেছেন। তবে, মুশকিল হল এভাবে চলতে থাকলে বোলারদের রাতের ঘুম হারাম হতে বাধ্য।

আসিফ অবশ্য সমালোচনা গায়ে মাখছেন না একদমই। বললেন, ‘আমি কে কি বললো দেখি না।। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফলো করি না একদমই। দলে আমার ভূমিকাটােই এমন যে কখনো দলে থাকবো, কখনো থাকবো না। এবার পাকিস্তান আমাকে চেয়েছে। আমি সারা বিশ্বে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলি। তো খেলাটা আমার মধ্যেই আছে, কখনোই দূরে সরার সুযোগ নেই। পারফরম করতে পারছি বলেই দলে আছি।’

আসিফের ব্যাপারে পাকিস্তানের পরিকল্পনা ‍খুব পরিস্কার। তাকে পাঠানোই হয় বলটাকে পেটানোর জন্য। তবে, বলকে পেটানোর জন্যও নিজের ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’ করতে হয়। তাই নিজেকে নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন আসিফ আলী। তিনি বলেছিলেন, ‘শেষ সিরিজটা আমার জন্য ভাল কাটেনি। তবে, আমি এরপর অনেক পরিশ্রম করেছি। তার ফলাফল এখন চোখেন সামনে। টিম ম্যানেজমেন্ট আমার জন্য একটা ভূমিকা ঠিক করে দিয়েছিল। আমি সেই অনুযায়ী অনুশীলন করে একজন ফিনিশারের ভূমিকায় নিজেকে প্রস্তুত করেছি।’

টুইটারে বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ শেষে ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস লিখলেন, ‘রিমেম্বার দ্য নেম, আসিফ আলী।’ এই বিশ্বকাপে আসিফ এখন অবধি যা করে চলেছেন – তাতে তাঁকে মনে না রাখার কোনো উপায় নেই।

চ্যালেঞ্জের কি আর শেষ আছে। এই এশিয়া কাপেও হাজারো স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন। রোজ ১০০-১৫০ টা ছক্কা হাঁকানোর অনুশীলন করেন বলে গণমাধ্যমে সমালোচিত হয়েছিলেন, স্যোশাল মিডিয়ায় ট্রল হয়েছিলেন। কয়েকটা ম্যাচে যেন ছক্ক হাকানোটা, বড় শট খেলাটা ভুলেই গিয়েছিলেন। তবে, বড় শটের দেখা তিনি সেদিনই পেলেন যেদিন সেটা সবচেয়ে বেশি জরুরী ছিল। আর সেই ইনিসেই তো জিতলো পাকিস্তান!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link