মধ্যপ্রাচ্যের শারজায় ক্রিকেটের কত অমৃত আসর বসেছে। শৈশবের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে এক টুর্নামেন্ট – শারজাহ কাপ। তারও আগে এশিয়া কাপের সূচনা আয়োজন বা অস্ট্রেলেশিয়া কাপ। টান টান উত্তেজনাকর পাকিস্তান-ভারত ফাইনালে চেতন শর্মার শেষ বল থেকে জাভেদ মিয়াঁদাদের ছক্কা। কত গল্প সেই ম্যাচ ঘিরে, শৈশবে রুপকথার গল্পের মতো কতবার শোনা হয়েছে তা।
মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট মানেই ব্লকবাস্টার হিট। কাড়ি কাড়ি টাকা। উপমহাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ বিশুদ্ধ বিনোদনের প্রত্যাশায় হয় স্টেডিয়াম-মুখো। ভরা গ্যালারি, নখ কামড়ানো উত্তেজনা, মাঠের ক্রিকেটে শতভাগ ঢেলে দেওয়া ক্রিকেটার; টিভি সেটের সম্মুখে থাকা দর্শকেরও সন্ধ্যাটা হয় সুন্দর। যেন পয়সা উসুল। কিন্তু আচমকা একদিন জানা গেল সেখানে শুধু ক্রিকেটের অমৃত আসর বসে না, ক্রিকেট ঘিরে জুয়ার আসরও গড়ে উঠেছে। বাজিকরদের স্বর্গ – শারজাহ।
ক্রিকেটের শুদ্ধ আঙিনা ফিক্সিংয়ের কলুষতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে সুতরাং জমজমাট শারজাহ কাপ আর বসে না সেখানে, কোনো ক্রিকেটই হয় না আর। পাকিস্তানের হোম গ্রাউন্ড হয়, দুবাই ও আবুধাবি। শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম একঘরে হয়ে পড়ে থাকে। বহু বছর পর পোর্ট সিটি লীগ বাংলাদেশ থেকে শারজা উড়াল দেয়, শৈশবের স্মৃতি ফিরে আসে আবার কৈশোর গোধূলীতে।
মধ্যপ্রাচ্য বহু ধুন্ধুমার ক্রিকেটের সাক্ষী।অনিশ্চয়তার ক্রিকেট বহুবার রঙ বদলের লুকোচুরি খেলেছে সেখানে। খেলাটা খুব উপভোগ্য ও নান্দনিক হয়ে ধরা দেয়। তারপরও কোনো বিশ্ব আয়োজনের গৌরব জোটেনি। এশিয়া কাপ বা অস্ট্রেলেশিয়া কাপ আয়োজনের মাধ্যমে বহুজাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজক হলেও, বিশ্বমঞ্চ রয়ে যায় অচেনা। কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। ভারতের জন্য যা দুর্ভাগ্য, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য তা-ই সৌভাগ্যের রাজমুকুট। কিন্তু দু:খের ব্যাপার, নিজেদের আয়োজনে বিশ্ব আসরে নিজেদেরই উপস্থিতি নেই। ইউএই – বাছাইপর্বের জটিল ধাঁধা সমাধানে ব্যর্থ।
নামিবিয়া জানিয়ে দিয়েছে আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আছে তারাও। জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া না থাকলেই-বা! আফ্রিকার ক্রিকেট এত সহজে মরবে না। আরব আমিরাতের বিশ্ব আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা চমৎকার। মাঠের ক্রিকেটও বেশ। পাকিস্তান ক্রিকেটে দিন বদলের গান, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে স্বস্তি।
ইংলিশ ক্রিকেটে ধ্বংসের আনন্দ, নিউজিল্যান্ডের ধীরস্থির ও হিসেবী ক্রিকেট পদক্ষেপ। দক্ষিণ আফ্রিকার চিরকেলে যন্ত্রণা, ভারতের ক্রিকেটে নতুন শুরুর প্রত্যাশা। শ্রীলঙ্কার গুছিয়ে উঠা, আফগান ক্রিকেটের সম্মুখযাত্রা। উইন্ডিজের সেই পুরনো রোগ, পরিকল্পনার অভাব। স্কটিশ ক্রিকেটের কুড়িয়ে নেওয়া ছোট ছোট প্রাপ্তি। আর বাংলাদেশ – এক সুদীর্ঘ হাহাকার!
ঠিক এক বছর পরের বিশ্বকাপে নতুন এক ভারতের দেখা পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যদি পরিবর্তন চোখে না পড়ে তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। সাফল্যের পালক জুড়ে গেছে ইতিমধ্যে। পরের আসরে বাংলাদেশ খেলবে সরাসরি মূল আয়োজন। অথচ ইংলিশ ক্রিকেট নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে চায় আরো। লিভিংস্টোন নামের এক ত্রিফলা-কে হাজির করেছে।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে নিজেদের। নতুন করে পরিকল্পনা সাজিয়েছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তান ক্রিকেট মাস দুয়েকের সমস্ত রাগ ঝেড়ে দেয়ার উপলক্ষে উপস্থিত হয়েছে শান দেয়া অস্ত্র নিয়ে। নামিবিয়ার ড্রেসিংরুমে আচমকা প্রবেশ, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে খেলোয়াড়ি শিষ্টাচার, হাস্যজ্জ্বল বাবর-রিজওয়ানের পাকিস্তান কেবল ট্রফিই জিততে আসেনি, খুব সম্ভব পাকিস্তান ক্রিকেটের একটা স্বতন্ত্র ব্র্যান্ডই সৃষ্টি করতে চায় তারা।
ইংলিশ ক্রিকেটের ধ্বংসাত্মক ব্র্যান্ড বা কিউই ক্রিকেটের সংযত ক্রিকেট-স্টাইল, নিঃসন্দেহে বহু পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফসল। ভারতীয় ক্রিকেটের অনিঃশেষ পাইপলাইনও সেই তিলে তিলে গড়ে তোলা সিস্টেমের ফল। আক্ষেপ হয়, হতাশ লাগে, দীর্ঘশ্বাস পড়ে, বাংলাদেশ ক্রিকেট কবে পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের সমন্বয় করা শিখবে?
দুই হাজার উনিশের ওডিআই বিশ্বকাপ এবং এবারের টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ, দুই আসরই কেমন ছকবাঁধা। কিঞ্চিৎ একঘেয়ে। অঘটন নেই, চমক নেই। ছোট দলের বড় হয়ে উঠার গল্প নেই। দৈত্য বধের ইতিহাস নেই। চার সেমিফাইনালিস্টের মধ্য থেকে দাপট বিবেচনায় পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ফাইনাল অনুমেয়। নিউজিল্যান্ডও চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, তবে অস্ট্রেলিয়াকে বাকি তিনটির সমশক্তির মনে হয় না। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-ই।
নিরানব্বই বিশ্বকাপে দারুণ দাপুটে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে টপকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। পাকিস্তান তেতে আছে খুব। দুটি লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নিউজিল্যান্ড ও ভারতকে হারাতে হবে। বাকি আছে আরো দুটি। ইংল্যান্ডকে হারাতে হবে, এবং চ্যাম্পিয়নশীপ। নিউজিল্যান্ড সুস্থির, শান্ত।
সোনালী প্রজন্মের হাতে উঠেছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, বিশ্বমঞ্চের সেরা হতে হবে এবার। সময়ের সঙ্গে মরগানের ইংল্যান্ড হয়ে উঠছে দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য। হাতের আঙ্গুল ফুরিয়ে যায় ইংল্যান্ডের ব্যাটার শেষ হয় না। বোলিংয়েও অপশন আছে। লিভিংস্টোন একইসাথে অফ স্পিনার ও লেগ স্পিনার, ব্যাটিংয়ে যেকোনো জায়গায়, যেকোনো অবস্থায় নামানো যায়। অসম্ভব মূল্যবান একটুকরো হীরকখন্ড।
পাকিস্তানের বোলিং দুর্দান্ত। পাঁচে পাঁচ জয়। কিন্তু অল আউট করতে পারেনি কোনো দলকেই। দুই ওপেনারই দারুণ ফর্মে, কিন্তু স্লো স্টার্টার। যদিও মিডল অর্ডারে হাফিজ-শোয়েবের অভিজ্ঞতা ও নীচের দিকে আসিফ-হাসান-ইমাদের পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি নির্ভার রাখছে। অস্ট্রেলিয়ার বোলিংও বৈচিত্র্যময়, কিন্তু ব্যাটিং এখনো নড়েবড়ে। ম্যাক্সওয়েল-স্টয়নিস-ওয়েড আস্থার নাম হননি কেউ। ম্যাক্সওয়েল, মার্শ বেশ ক’দিন যাবৎ বেশ ধারাবাহিক। ওয়ার্নারের ব্যাটে ফর্মের ফেরার ইঙ্গিত। তবুও পাকিস্তানের দিকেই সম্ভাবনার পাল্লা ঝুঁকবে।
ইংলিশ ক্রিকেটের ফুল প্যাক পাওয়ার হাউজের বিপরীতে নিউজিল্যান্ডের সদলবলে লড়াইটা উপভোগ্য হওয়ার কথা। ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয়তম ম্যাচের দুই প্রতিপক্ষ আরো একবার বিশ্বমঞ্চে মুখোমুখি। উইলিয়ামসনের বুদ্ধির সঙ্গে টেক্কা দিতে মরগানের জুড়ি নেই। লড়াইটা সেয়ানে সেয়ানে। তবুও ইংলিশ ক্রিকেটের পক্ষেই সম্ভাবনার পালা হেলে থাকবে।
আর পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ফাইনাল যদি হয়, ইংলিশদের জন্য বিশ্বকাপ জেতা বড্ড কঠিন হয়ে যাবে। ভরা গ্যালারির প্রায় পুরোটা জুড়েই দর্শক গলা ফাটাবে পাকিস্তানের পক্ষে। প্রতিপক্ষের ডেরায়, হাজার দর্শকের চাপ সামাল দিয়ে স্নায়ুচাপ ঠিক রেখে ফাইনাল জেতা অতিমানব হলেই সম্ভব।
ইংলিশ ক্রিকেটে অতিমানব আছে, তবে দলটা অতিমানবদের একাদশ নয় নিশ্চয়! অবশ্য মানব একাদশের পক্ষেও জেতা সম্ভব, যদি পাকিস্তান বিশ্রী রকমের বাজে খেলে। দলটা পাকিস্তান বলে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই, কিন্তু এই পাকিস্তান এই পর্যন্ত বদলে যাওয়া ক্রিকেটই উপহার দিয়েছে।
সবাই বদলে যায়। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকাও। এই মঞ্চে ভিন্ন কোনো আয়োজনে ভারত প্রবল প্রতাপে ফিরবে নিশ্চিত। পরিবর্তনের পথে হাঁটে সকলে। কেবল বাংলাদেশ থেকে যায় যেমন-তেমন। যেন সংস্কার বা পরিবর্তনে বিশ্বাস নেই।
মাঝেমধ্যে কেবল অধিনায়ক অপসারণ বা ক্রিকেটার পরিবর্তন, এই যা। চিন্তা চেতনায় ধ্যান ধারণায় সংস্কারের কথা ভাবেও না কেউ। তাই বন্দুকের নল তাক করা ও বন্দুকধারী একই থাকে, কিন্তু পালটে যায় বন্দুকের সামনে থাকা মানুষ।
দর্শকদেরও চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন প্রয়োজন। ক্রিকেট সামান্য খেলা মাত্র। এই নিয়ে অতি আবেগ ও উত্তেজনার ফল ভালো হয় না। সবকিছুতে ভারতের ষড়যন্ত্র, ফিক্সিং টেনে এনে খেলাটাকে দূষিত করার মানে নেই। ভালো না লাগলে বা সংশয় থাকলে ক্রিকেট না দেখলেই হয়। কলুষতা, বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা ছড়ানোর কোনো কারণ নেই।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার এবারের বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখলেই হয়। খেলাধুলা মূলত সম্প্রীতি ও সম্পর্কের মানোন্নয়নের জন্য, বিনোদন ও আনন্দের জন্য। যতক্ষণ খেলা চলবে সর্বোচ্চ নিংড়ে দেয়া হবে, প্রতিপক্ষের কোনো ছাড় নেই। খেলা শেষে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা ঠিক বজায় থাকবে।
আমরা যারা ক্রিকেট দর্শক, আমাদের সবার আগে ক্রিকেট খেলাটাকে উপভোগ করা শিখতে হবে। কেবল জয় উপভোগ করা মানে কিন্তু ক্রিকেট নয়।