আক্ষেপের আঁধারে প্রতিশ্রুতির আলো

২০০৬ কি ২০০৭ সালের কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সম্ভাবনাময় এক অলরাউন্ডার মনে করা হত সোহরাওয়ার্দী শুভকে। ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্সে সাকিব আল হাসানের চেয়ে  তখন কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না তিনি। সেই সোহরাওয়ার্দী শুভ আর সাকিবের ক্যারিয়ার গ্রাফে আজ আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

১৯৯৯ সাল থেকেই ক্রিকেটে পদচারণা। বয়সভিত্তিক দলে খেলতেন শুভ। স্লো লেফ আর্ম অর্থোডক্স বোলিং আর লোয়ার-মিডল অর্ডারে তার ব্যাটিংটা ছিল বেশ কার্যকরী। এরপর সুযোগ পান রাজশাহী বিভাগের হয়ে খেলার। সেখানেই ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ২০০৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন। সাকিব, তামিম, মুশফিকরাও ছিলেন একই দলে!

শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপে ১৪.৪৪ গড়ে ৬ ম্যাচে ৯ উইকেট শিকার করেন শুভ। সেই ব্যাচ থেকেই সাকিব, তামিম, মুশফিকরা জায়গা করে নেন জাতীয় দলে। ২০০৮ অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপেও খেলেন শুভ। সেখানেও জাতীয় দলে খেলা নাসির হোসেন, রুবেল হোসেনদেরকে পেয়েছিলেন সতীর্থ হিসেবে। সেই দলের অধিনায়কও ছিলেন তিনি। ওই বিশ্বকাপের পর জাতীয় দলে ডাক পেতে অপেক্ষা করেছিলেন আরও প্রায় দুই বছর।

ততদিনে সাকিব, তামিম, মুশফিকরা জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ। নাসির, রুবেলরাও জাতীয় দলে তরুণ হিসেবে খেলছেন। এরপর ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন শুভ। লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে শেষদিকে ৬ বলে ১৪ রানের ক্যামিও উপহার দেন তিনি। বল হাতে মাত্র ৩ ওভার করার সুযোগ পেয়েছিলেন এই স্পিনার।

ক্যারিয়ারের প্রথম চার ম্যাচে শিকার করেছিলেন মাত্র ১ উইকেট। তবে বল হাতে ছিলেন বেশ ইকোনমিকাল। ২০১০ সালেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম ম্যাচেই ১৪ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৩ উইকেট নেন শুভ। ওই সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবার ৪-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। সেখানে ৩ ম্যাচে ৪ এর কম ইকোনমিতে ৫ উইকেট শিকার করেন শুভ।

ওই বছরই এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলে সুযোগ পান তিনি। সেবার ফাইনালে আফগানিস্তানকে হারিয়ে স্বর্ণ জেতে বাংলাদেশ। ওই বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবার টি-টোয়েন্টিতে ডাক পান শুভ। ১ ম্যাচে পেয়েছিলেন সুযোগ। ব্যাট হাতে ৩ বলে ১ আর বল হাতে ১ ওভারে ১২ রান দেওয়ার পরই বাদ পড়লেন! এরপর আর টি-টোয়েন্টিতে ফিরতে পারেননি তিনি।

এরপর ২০১১ বিশ্বকাপে ডাক পান শুভ। তবে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র এক ম্যাচে খেলার! নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ৩৩ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও ছিলেন দলে। প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শিকার করেন ৪৪ রানে ৩ উইকেট। তবে দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল শুভর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে দিন!

ওই ম্যাচে শেন ওয়াটসনের তান্ডবে মিরপুরে ছক্কা বৃষ্টি দেখেছিল বাংলাদেশী সমর্থকরা। ২৩২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ওয়াটসন একাই করেন ৯৬ বলে ১৫ চার ও ১৫ ছক্কায় ১৮৫ রান! শুভ ৩ ওভার বোলিং করে বিনা উইকেটে দেন ৪৬ রান! এর মাঝে এক ওভারেই ওয়াটসন চার ছক্কা হাঁকান। এই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ ওয়ানডেতে অবশ্য বেশ ইকোনমিক বোলিং করেন শুভ।

এরপর ২০১১ সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬২ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে ৩ ওভারে ১ মেইডেনসহ ২ ওভারে ১ উইকেট শিকার করেন শুভ। কিন্তু তবুও পরের সিরিজে আর জায়গা হয়নি এই স্পিনারের। ভাল পারফরম্যান্সের পরেও বাদ পড়েন দল থেকে। ওয়ানডের জার্সিটি আর গায়ে জড়াতে পারেননি এই স্পিনিং অলরাউন্ডার।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৭ ম্যাচে মাত্র ২ বার তার বোলিং ইকোনমি ছিল ৬ এর বেশি! এছাড়া প্রতি ম্যাচেই বেশ ইকোনমিক্যাল বল করেছে শুভ। দলে বোলিং অপশন বেশি থাকায় প্রায় ম্যাচেই সুযোগ পাননি খুব বেশি ওভার করার। লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং আর বল হাতে পার্ট টাইমারের ভূমিকায় আসা দলে শুভর ভূমিকা কি সেটি নিয়েও উঠেছিল প্রশ্ন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পর ওই সিরিজেই টেস্টে ডাক পেয়েছিলেন শুভ। মিরপুরে দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেয়ে ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে ১৫ ও ০ এবং বল হাতে দুই ইনিংসে শিকার করেন ৪ উইকেট। বড় ব্যবধানে পরাজয়ের পর সাদা পোশাকে আর দেখা যায়নি শুভকে। শুধু সাদা পোশাকেই নয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যাত্রাটাও শেষ ১ বছরের মাথায়ই!

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১ টেস্ট, ১৭ ওয়ানডে আর মাত্র ১ টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন শুভ। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের ঝুলিতে নিয়েছেব বল হাতে ১৮ উইকেট আর ব্যাট হাতে ব্যাট হাতে আছে ৩৬ রান। ওয়ানডেতে তার ইকোনমিটাও বেশ কম। মাত্র ৪.৫ ইকোনমিতেই বল করেছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঠিক উল্টো চিত্র ঘরোয়া ক্রিকেটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০৫ ম্যাচে ৩৫৯, লিস্ট এ তে ১২৬ ম্যাচে ১৬১ ও ৬৯ টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ৪৯ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ২৩ বার পাঁচ ও ২ বার নিয়েছেন ১০ উইকেট। ৬ সেঞ্চুরি আর ২৮ ফিফটিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে করেছেন ৬ হাজারেরও বেশি রান।

সাবেক ব্ল্যাকক্যাপ অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে ছোটবেলা থেকেই অনুসরণ করতেন। ২০১০ সালের ওয়ানডে সিরিজের সময় আইডলের সাথে খেলার সৌভাগ্যও হয়েছিল শুভর। শুধু খেলাই নয়, ভেট্টোরি-ম্যাককালামদের নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশও করেছিল সাকিব-শুভরা।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই পারফর্ম করলেও জাতীয় দলে আর নিজেকে খুঁজে পাননি এই স্পিনার। আসলে ওই সময়ে দেশের ক্রিকেটে ছিল বাঁ-হাতি স্পিনারদের প্রাচুর্য্য। ফলে, জায়গা ধরে রাখাটা সহজ হয়নি। ওয়ানডেতে যে  ক‘ম্যাচই খেলেছেন, ছিলেন দলের নিয়মিত পারফর্মার।

তবে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে কখনোই নিজেকে প্রমাণের জন্য পাননি সুযোগ। এক সময়ের সম্ভাবনাময়ী এই ক্রিকেটার এখন ঘরোয়া ক্রিকেটেই ক্যারিয়ারের শেষটা দেখছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link