২০০৪ বা ২০০৫ সালের কথা। প্রথম আলোতে ছোট্ট কী একটা অনুষ্ঠান। বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের অতিথি করে আনা হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো তুষার ইমরানকে নিয়ে আসার।
অনুষ্ঠান শেষ।
ছয় তলা থেকে আমরা নামবো। লিফটের জন্য অপেক্ষা করছি। ডান পাশের লিফটটার সুইট চেপে অপেক্ষা করছি। অনুষ্ঠানের ক্লান্তি হোক আর অন্য কোনো কারণে তুষার একটু ক্লান্ত মনে হয়। পাশের লিফটের দরজায় হাত ঠেকিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তুষার এবং উপস্থিত আমাদের আরও কয়েক জনকে বজ্রাহত করে তুষারের হাতের ছোয়াতে সেই লিফটের মুখে দাড় করানো দরজার মতো দেখতে জিনিসটা ধ্বসে পড়লো।
পেছনে কিছু নেই। একেবারে সোজা সুড়ঙ্গ।
মেরামতের জন্য লিফট খুলে রাখা হয়েছে। কোনো এক কারণে এই ফ্লোরে দরজাটাও নষ্ট হয়েছে। তাই নিরাপত্তা হিসেবে সেখানে একটা হাডবোর্ড বসানো ছিলো। সেটাই ধ্বসে পড়েছে। কে যেনো টেনে ধরে তুষারেরও পতন ঠেকালেন।
সকলে ‘ইস্, আহা’ করছে এবং আমি কুলকুল করে ঘামছি। আমার ঘন নিশ্বাস দেখে তুষারই এগিয়ে এলো। হাসতে হাসতে বলছিলো, ‘এতো ভয় পাওয়ার কী আছে?’
নিজেকে একটু সামলে রসিকতা করেছিলাম, ‘ভয় পাবো না? বাংলাদেশের ভবিষ্যত অধিনায়কের দূর্ঘটনার কারণ হিসেবে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে আমার নাম উঠে যেতো!’
ভবিষ্যত অধিনায়ক!
হ্যাঁ, তেমনটাই তখন হিসেব ছিলো। তুষার ইমরানকে মনে করা হচ্ছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত এবং ভবিষ্যতের নেতা।
একটু কলার উঁচু, একটু ঠোটকাটা, স্টাইলিশ এবং রানের পর রান করতে থাকা তুষারকে নিয়ে কারোরই সংশয় ছিলো না। আমরা যারা একটু ঘনিষ্ঠ, তারা জানতাম, ও বুকের ভেতর থেকে খেলে এই খেলাটা। বোর্ডও সে সময় হাওয়াটা বুঝেছিলো। জাতীয় দলের বাইরে ‘এ’ দলের খেলা থাকলেই অধিনায়কত্ব দেওয়া হতো তুষারকে।
কিন্তু সেই তুষার আস্তে আস্তে কী করে যেন হারিয়ে গেলো। বলা ভালো, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে হারিয়ে ফেলা হলো তুষারকে। তুষারের বিপক্ষে অভিযোগ হলো, সে ধারাবাহিক নয়। বলা হলো, তুষার অনেক সুযোগ পেয়েছে। তুষার নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি।
সাদা চোখে এই অভিযোগগুলোকে সত্যি বলে মনে না করার কারণ নেই।
৪১ ওয়ানডেতে ১৪.৩৫ গড়ে ৫৭৪টি মাত্র রান করেছেন। হ্যাঁ, মাত্র ১৪.৩৫ গড়। শেষ ৩৬টি ম্যাচে কোনো ফিফটি নেই। এই ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে এসব অভিযোগ বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। আমি জানি, যারা এই লেখা পড়ছেন, তারাও এখনকার তুষারের ভক্ত হলেও মনে করেন, তিনি আসলেই নিজেকে সে সময় প্রমাণ করতে পারেননি।
আসলেই কী তাই? একটু পেছনে ফিরে যাই চলুন।
তুষার ৪১ টি ওয়ানডে খেলেছেন। ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁর অভিষেক হয়েছে এবং এখন অবধি শেষ ম্যাচ খেলেছেন ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। মানে ৬ বছরের একটু বেশি সময়ে তিনি ৪১টি ওয়ানডে খেলেছেন। এবার বলুন তো, এই সময়কালে বাংলাদেশ কতোটি ওয়ানডে খেলেছে?
১২২ টি। ঠিক শুনেছেন, বাংলাদেশ দল ১২২ টি ওয়ানডে খেলেছে তুষারের এই ক্যারিয়ার কালে।
মানে, তুষারকে জাতীয় দলের হয়ে ৪১টি ম্যাচ খেলতে বাইরে বসে থাকতে হয়েছে ঠিক ৮১ টি ম্যাচ। বিশ্বাস করতে পারেন, এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান?
মজার ব্যাপার হলো, এই ১২২ ম্যাচের বেশীরভাগ সময়ই তুষার দলের সাথে সাথে থেকেছেন। একাদশে জায়গা হয়নি তার। মানে, ক্যারিয়ারের দুই তৃতীয়াংশ সময় পানি টেনে টেনে কেটেছে!
তুষার নাকি যথেষ্ঠ সুযোগ পেয়েছেন!
এখন যাদের স্মৃতি ভালো, তারা একটু এই ‘সুযোগ পাওয়ার’ প্যাটার্নটা মনে করে দেখুন। বিভিন্ন সিরিজে তুষারের ভাগ্যে জুটতো শেষ ম্যাচটা সাধারণত। মানে, তখনকার বাংলাদেশ দল নিয়মিতই সিরিজের এক ম্যাচ হাতে রেখে হেরে বসতো; তখন ওই অর্থহীন ম্যাচ খেলতে নামানো হতো। আবার কখনো সিরিজ নির্ধারনী ম্যাচে নামিয়ে পরের ম্যাচেই আবার নেই।
ক্যারিয়ারে কখনোই টানা ১০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তুষার ইমরান। সেই কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো ম্যাচেও দারুন শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন দলকে। কিন্তু এমন টুকরো টুকরো হরেক শুরুকে কখনোই বড় ইনিংসে পরিণত করার আত্মবিশ্বাসটা পাননি ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে। সবসময়ই জেনেছেন, পরের ম্যাচেই হয়তো নেই; যা করার এখনই করতে হবে।
এভাবে ৪১ ম্যাচ কেনো, ৪১০ ম্যাচ খেললেও কেউ ধারাবাহিক হতে পারে না।
তুষার ইমরানের কৃতিত্ব হলো, তিনি আর দশ জনের মতো এখান থেকে হারিয়ে যাননি। এমন অবহেলায় বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারও আছেন দু চার জন। তুষার নিজেকে ধরে রেখেছেন। শুধু ধরে রেখেছেন বললে ভুল হবে। নিজেকে আরও শক্ত করে তুলেছেন।
বলা ভালো, ২০০৭ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরই আসলে তুষার আসল রূপে ধরা দিয়েছেন। একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে, তুষারের সোনালী সময় শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। তুষার নিজেও এই সময়টাকে নিজের সেরা সময় বলে উল্লেখ করে থাকেন।
কেমন সেই সোনালি সময়টা?
২০১৪-১৫ মৌসুমে তুষার ৮৩.৬০ গড়ে ৮৩৬ রান করেন। এটাকে আপনি একটা শুরু বললে গত মৌসুম পর্যন্ত তুষারের ব্যাটে এই রান বন্যা চলেছে। এর মধ্যে তুষার টানা দুই মৌসুমে এক হাজারের ওপর রান করেছেন; মোট ৫ মৌসুমে ৮ শ-এর ওপরে রান করেছেন। গড় রেখেছেন ৭০ থেকে ৮০-এর ওপরে।
প্রথম জীবনে তুষারের সাথে যে অন্যায় হয়েছে, সেটা ভুলে গিয়েও বলা যায়, সেরা অন্যায়টা হয়েছে, এই দূরন্ত সময়টাতে তাকে টেস্ট দলে ডাকা হয়নি। অদ্ভুত সব অজুহাত দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ফিটনেস ভালো নেই।
প্রথম কথা হলো, ফিটনেস ভালো না থাকলে টানা এভাবে দিনের পর দিন ব্যাট করে যাওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয় কথা আর্ন্তজাতিক মানের ফিটনেস না থাকলে সেটাকে মাত্র এক সপ্তাহ জিমের মাধ্যমে ট্রেনাররা ঠিক করে নিতে পারেন। ফলে তুষারকে ওই সময় টেস্ট দল থেকে দূরে রাখাটা দেশের জন্যই মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে।
যাক, সব আফসোসের শেষ আছে।
তুষারের বিদায় ঘোষনার ভেতর দিয়ে চলমান এই আফসোসটা স্মিত হলো। তবে বুকের মধ্যে আগুনটা জ্বলতেই থাকবে। দুটো আগুন জ্বলবে তুষারের বুকে। আর ২৮টা রান হলেই দেশের একমাত্র ১২ হাজার রানের মালিক হয়ে যেতেন। এই আফসোসটাও নিশ্চয়ই বয়ে বেড়াবেন তুষার।
তবে খুব করে চাইবো, আফসোসটা ভুলে নিজের আগুনটা যেনো ছড়িয়ে দেন তিনি।
বিদায়ের সময় বলেছেন, কোচিংয়েই থাকবেন। ইতিমধ্যে ঢাকার একটি ক্লাবের কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরীর শিষ্য। স্বপ্ন দেখি জালাল ভাইয়ের মতই ক্রিকেটার তৈরি করার কারিগর হয়ে উঠবেন তুষার।
আগুনটাকে নিভতে দেবেন না, তুষার। সেটাকে ছড়িয়ে দিন তরুণদের মধ্যে।