একটা দল বিশ্বকাপে যাচ্ছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপ। দেশের মানুষজনের প্রত্যাশা হয়ত জিতবে দুই কিংবা একটি ম্যাচ। এর বেশি কিছুই প্রত্যাশা করা ঠিক না। দলটা যে একেবারেই আনকোড়া। এদের থেকে বেশি প্রত্যাশা করা মানে স্বপ্নের অকালমৃত্যু। তাছাড়া পুরো বিশ্বের এমন বাঘাবাঘা দলের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে একটি ম্যাচও তো জেতা কম নয়। বিশ্বের তাচ্ছিল্য তো রয়েছেই।
তো এমন মনোভাব নিয়েই ভারত জাতীয় ক্রিকেট দল পৌঁছালো ইংল্যান্ডে। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ইংল্যান্ডেই। ব্যবস্থাপনায়ও তাচ্ছিল্যের স্বীকার হয়েছিল তখন। এসব কিছু উপেক্ষা করে তাঁরা নিজেদের খেলাটা খেলা যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে এবং পরিশেষে কি ঘটেছে তা তো সবারই জানা।
মাত্র ১৮৩ রানের পুঁজিতে তৎকালীন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ও তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরেছিল ভারত। লর্ডসের বারান্দায় ট্রফি উঁচিয়ে ধরা কপিল দেবের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছিল পুরো বিশ্ব। কি অবাক করা কাণ্ড!
সম্প্রতি ভারতে মুক্তি পেয়েছে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক এক সিনেমা ‘৮৩’। যেখানে ভারত ক্রিকেট দলের ১৯৮৩ বিশ্বকাপের যাত্রা, তাঁর পাশাপাশি সেই বিশ্বকাপ দলে থাকা প্রত্যেক সদস্যের অবদানও ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। এমনকি সেই বিশ্বকাপ জয়ী দলে থাকা ম্যানেজার পিআর মান সিং এর চরিত্রও রয়েছে।
তাঁকে অবহেলা করবার সুযোগ খুবই কম। কেননা সেই বিশ্বকাপ দলটিকে পেছন থেকে নেতৃত্ব তো তিনিই দিয়েছিলেন। তাঁরও তো রয়েছে সমপরিমাণ অবদান। তবে এই যে পিআর মান সিং ভারত ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হলেন তারপর, বিশ্বকাপ জয়ী ম্যানেজারদের একজন হলেন এই পুরোটা পথে ভিন্ন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।
মান সিং মূলত ছিলেন একজন সাবেক ক্রিকেটার। বাবার হাত ধরে ক্রিকেটের ময়দানে নেহায়েৎ একজন দর্শক হিসেবে গিয়েছিলেন কোন এক ম্যাচ উপভোগ করতে। সেখান থেকেই হয়ত মনে জেগেছিল বাসনা, যুক্ত হবেন ক্রিকেটের সাথে। তবে খুব অল্প বয়সেই তিনি যে ক্রিকেটে নেমে পড়েছিলেন তা নয়। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ক্রিকেটের প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন মান সিং। এমনকি প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন হায়দ্রাবাদকে। দীর্ঘ প্রায় চার বছরে তিনি ম্যাচ খেলেছিলেন পাঁচটি।
তবে খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেটের সাথে যুক্ত থাকার চাইতে মান সিং এর অধিক পছন্দ ছিল একজন সংঘঠক হিসেবে ক্রিকেটে সংপৃক্ত থাকা। যার ফলশ্রুতিতে খেলোয়াড়ী জীবন খুব একটা বেশি লম্বা ছিল না তাঁর। তিনি ইউনিভার্সিটির হয়ে খেলাকালীন সময়েই ম্যাচের ফিক্সার জেনে রাখা, কাদের বিরুদ্ধে কবে কোথায় খেলতে হবে, দলকে একত্রিত করা এ ধরণের সাধারণ সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হতে শুরু করেন।
তবে তাঁতে বেশ নজর কেড়েছিলেন তিনি। তৎকালীন হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গুলাম আহমেদ মান সিং-কে তাঁর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হবার প্রস্তাব দেন। নিজের পছন্দমত কাজ ফিরিয়ে দিতেন কি করে মান সিং।
তারপর হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে নিজের প্রথম আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক জীবনের যাত্রা শুরু করেন মান সিং। গুলহাম সিং পদোন্নতি হয়। তিনি নিযুক্ত হন বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া এর সেক্রেটারি পদে। সুতরাং হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন সভাপতির পদ খালি হয়ে যায়। নিজের কর্মদক্ষতার বলে সেই জায়গায় গুলাম আহমেদের স্থলাভিষিক্ত হন মান সিং। বনে যান হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। ১৯৭৮ সাল অবধি তিনি সেই দায়িত্বই পালন করে গিয়েছিলেন। তারপর যখন ভারত জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজার হবার প্রস্তাব না আসা অবধি।
মান সিং এর জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজার হবার পেছনেও রয়েছে এক গল্প। সেই গল্পে খানিক রাজনীতিও রয়েছে। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানে যাবে ভারত ক্রিকেট দল। মূলত খেলা দিয়ে দুই দেশের মাঝে চলা বৈরিতা মোচনের রাজনৈতিক প্রয়াস হিসেবেই এমন উদ্যোগ। ক্রিকেটের আড়ালে রাজনৈতিক আলাপচারিতাই মূল লক্ষ্য। তো সেই অনুযায়ী ভারত দলের ম্যানেজার হয়ে পাকিস্তানে যাবেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
বারোদার মহারাজার উপর অর্পিত হলো ম্যানেজারের দায়িত্ব। মান সিং এর সাংগঠনিক দক্ষতার চর্চা তখন ভারতের ক্রিকেট মহলে নতুন কিছু নয়। তাই বাড়োদার মহারাজ দলের ম্যানেজারের হবার জন্য এক শর্ত জুড়ে দিলেন। মান সিং যদি তাঁর সহকারী হয়ে পাকিস্তান যান তবেই কেবল তিনি যাবেন।
এভাবেই দলের সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে দলের ম্যানেজার হয়ে তিনি দলের সাথে ইংল্যান্ড যাবার আগে বেশকিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে কপিল দেবকে অধিনায়ক করা ছিল অন্যতম। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের পর তিনি ১৯৮৭ বিশ্বকাপ অবধি ছিলেন দলের ম্যানেজারের দায়িত্বে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারতের কোনো কোচ ছিল না, ছিল না কোনো সাপোর্টিং স্টাফও, পুরো দলটাকে এক হাতে সামলান এই মান সিং।