‘লিটন আমার একার নয়; সারা দেশের ছেলে’

দিনাজপুর শহরেই বাচ্চু দাসের একটা গয়নার দোকান আছে। একটু বেলা করেই দোকান থেকে বাড়ি ফেরেন।

সেদিনও বিকেল বেলা বাড়ি ফিরেছিলেন হাতের কাজ শেষ করে। বাড়িতে গিয়ে একটু স্থির হওয়ার আগেই ছেলের খোজ করলেন। ছেলের মা একটু বিব্রত হয়ে বললেন, সে খেলতে চলে গেছে। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখেই, না খেয়ে মাঠে চলে গেছে।

বাচ্চু দাস খেপে গেলেন; আজ ছেলের একদিন, কী আমার একদিন। খেপে মাঠে ছুটলেন ছেলেকে ধরে আনতে। কিন্তু মাঠে ঢুকেই শান্ত হয়ে এলেন। চোখ পড়লো ছেলের ওপর।

শান্ত ছেলেটা তার কোচকে নিয়ে গভীর মনযোগ দিয়ে ব্যাটিং করছে। নেটে দাড়িয়ে নয়ন জোড়ানো সব শট করছে। দীর্ঘ দিন টিভিতে খেলা দেখার অভিজ্ঞতায় শটগুলোর নান্দনিকতা ধরতে দেরি হলো না বাচ্চু দাসের। তিনি কোনো কথা না বলে মুগ্ধ-নির্বাক হয়ে দেখছিলেন ছেলের ব্যাটিং।

আজও তাই ঘটে।

সেদিন বাচ্চু দাস একা মুগ্ধ হয়েছিলেন; আজ সারা বিশ্ব মুগ্ধ হয়। সেদিন একজন বাবা নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন; আজ হর্ষ ভোগলের মত পণ্ডিত নির্বাক হয়ে যায়। সেই ছোটবেলা থেকে এমন করেই সব আক্রমনকারী, সব বিশ্লেষক, সব পণ্ডিকে মুগ্ধ করে যাচ্ছেন লিটন কুমার দাস। বাচ্চু দাসের সেই ছোট্ট ছেলেটি লিটন দাস।

বাচ্চু দাস অবশ্য হেসে বলেন, ‘ও কী আর আমার একার ছেলে আছে? ও এখন এই দেশের ছেলে। ও এখন সবার সম্পত্তি।’

অবশ্য লিটনের এই সার্বজনীনতা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর পেছনে বাবার, মায়ের কম অবদান নেই। তাদেরই সম্মতিতে বিকেএসপি হয়ে জাতীয় দলের তারকা হয়েছেন লিটন। সেই সময়টার কথা বড় মনে পড়ে বাচ্চু দাসের।

সেবার দিনাজপুর জেলা অনুর্ধ্ব-১৬ দল গঠনের জন্য ট্রায়াল হচ্ছিলো। ছেলেরা কাতারে কাতারে গিয়ে নাম লেখাচ্ছিলো। লিটনও তার বড় ভাই বাপ্পী দাসের কাছে এসে বায়না করলো, ‘আমিও নাম লেখাতে চাই।’

কথাটা বাচ্চু দাসের কানে গেলো। তিনি বললেন, ‘তুমি তো কাঠের বলেই (ক্রিকেট বলে) খেলতে পারো না এখনও। তোমার নাম লেখানোর দরকার নেই।’

লিটন তখন চুপ করে রইলেন। ক দিন পর বাবা শুনলেন, লিটন সেখানে ট্রায়াল দিয়েছে এবং ১৫ জনের একজন হিসেবে দলে জায়গাও পেয়েছে। এরপর আর ছেলেকে আটকে রাখা যায় না। বুকে পাষান বেঁধে ছোট্ট ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন। সে আজ কলকাতা, কাল ক্রাইস্টচার্চে খেলে বেড়ায়। লিটন দাস আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠেন। আর বাচ্চু দাস আস্তে আস্তে নতুন এক পরিচয় পেয়ে যান।

তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বাচ্চু দাস বলছিলেন, ‘আমার নামটাই তো হারিয়ে গেছে। সবাই বলে-লিটন দাসের বাবা। রাস্তা থেকে হাটার সময় লোকে বলে-লিটন দাসের বাবা যায়। আমি এখন লিটন দাসের বাবা নামেই পরিচিত। ক জনের ভাগ্যে এমন হয়, বলেন?’

বড় সত্যি কথা। এমন ভাগ্য ক জন বাবার কপালে জোটে! নিজের পরিচয়টা হয়ে ওঠে ক জনের ছেলের নামে?

ছেলের এই তারকা হয়ে ওঠা, রানের পর রান করতে থাকা বাচ্চু দাসকে আপ্লুত করে। তবে তিনি এই ব্যাপারটাকে একার করে রাখেন না। বলেন, ‘আমি একজন বাংলাদেশী হিসেবেই ওর খেলা দেখে আনন্দ পায়। দেশের কোটি কোটি মানুষ ওকে দেখে যেমন আনন্দ পায়, তাই পাই। কেবল ওর বাবা বলে বিশেষ আনন্দ পাই, তা না।’

এই সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারাটাও একটা বড় পারা। এ বুঝি কেবল লিটন দাসের বাবার পক্ষেই সম্ভব।

মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। সাফল্যের এই স্রোতের ক দিন আগেই তো ব্যর্থতার বান দেখেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। আজ যারা শতমুখে প্রশংসা করছে, তারাই তখন গালি দিয়েছিলো। এই গালিটা কী গায়ে লাগে না? তখন কী নিজেকে বড় একা মনে হয় না?

বাচ্চু দাস হাসেন। বলেন, ‘এটাই পৃথিবীর নিয়ম। খারাপ সময়ে আপন একা হয়ে যাবেন। কথায় বলে, ভালো করলে তালি এবং খারাপ করলে গালি। তালিটা মেনে নিলে, গালিটাও নিতে হবে। প্রার্থনা করবেন, ওর ভালো সময়টা যেনো লম্বা হয়।’

তাই হোক। লিটন দাসের এবং বাংলাদেশের ভালো সময় দীর্ঘায়িত হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link