কোচকে ব্যস্ত রাখার নতুন কৌশল বাফুফের

জাতীয় ফুটবল দলের নতুন কোচ হিসেবে ১১ মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্পেনের হাভিয়ের কাবরেরাকে। বাংলাদেশে এসে দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। যদিও অনেকে মনে করতে পারেন, সামনে জাতীয় দলের কোন খেলা নেই অথচ কোচ কিভাবে ব্যস্ত থাকেন?

বিগত দিনে যারাই জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন তাদেরকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি কোন কাজ দিতে পারেনি। তাই নানা ছুতোয় তারা ছুটি কাটিয়েছেন। সর্বশেষ কোচ ইংল্যান্ডের জেমি ডে’র ক্ষেত্রেও তেমনটি দেখা গেছে। বাংলাদেশের চেয়ে ইংল্যান্ডই ছিল তার বেশি প্রিয়।

তার আগে বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যারাই লাল সবুজের সিনিয়র দলের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন তাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। নানা সমালোচনার পর এবার নতুন ধারা তৈরি করতে শুরু করেছে বাফুফে। কোচ কাবরেরাকে কিভাবে ব্যস্ত রাখা যায় সেই পরিকল্পনা নিয়েই তার সাথে চুক্তি করা হয়েছে। জাতীয় দলের মধ্যে নিজের কাজকে সীমাবদ্ধ না রেখে সেটিকে ক্লাব পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে কোচ হিসেবে শুরুটা করেছেন ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের অনুশীলন দেখার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্লাব দল হিসেবে কাবরেরা গিয়েছেন উত্তর বারিধারায়। এরপর পর্যায়ক্রমে পেশাদার লিগের সকল ক্লাবেই যাবেন তিনি। জাতীয় দল গঠনের জন্য একটা ক্লাবকেও সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা থেকেই এমনটি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম কাজটি শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও সেটি ভেস্তে গেছে বাফুফের অপরিপক্কতার কারণে।

জাতীয় দলের ছয় জন ফুটবলারের করোনা ভ্যাকসিনের দুই ডোজ সম্পন্ন না হওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই জানুয়ারীরর শেষ সপ্তাহে প্রীতি ম্যাচ খেলা থেকে সরে আসতে হয়েছে। সে কারণে জাতীয় দলের কার্যক্রম না থাকায়, ঢাকায় আসার পর কোচকে যাতে অলস সময় পার করতে না হয় সেজন্য ক্লাবগুলো পরিদর্শন ও এরপর প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখার দায়িত্ব দিয়েছে বাফুফের জাতীয়দল ব্যবস্থাপনা কমিটি।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ফুটবলের খেলা শুরু হবে তিন ফেব্রুয়ারি। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার স্পোর্টস কমপে¬ক্স ও ঢাকার বাইরের ৬ ভেন্যুতে হবে বিপিএলের খেলা। নতুন কোচ ভেন্যুতে ভেন্যুতে ঘুরে লিগের খেলা দেখে দেখে খেলোয়াড় বাছাই করবেন। তার আগে তিনি পরিদর্শন করছেন বিপিএলের অংশগ্রহনকারী ১৩ ক্লাব। এসব ক্লাবের অনুশীলনের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা ও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ক্লাব পরিদর্শনের মধ্যেই জাতীয় দলের জন্য নতুন খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজটিও করে নেবেন।

কাররেরাকে সহায়তার জন্য দুজন সহকারী কোচ নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। মাসুদ পারভেজ কায়সার ও বিপ্লব ভট্টচার্যকে সহকারী ও গোলরক্ষক কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোচের ইচ্ছেমতে জাতীয় দলের সঙ্গে আপাতত বিদেশি কোচিং ষ্টাফ নেওয়া হচ্ছে না। এখন থেকে দেশিরা সহকারী হিসেবে কাজ করবেন বলে জানা গেছে। বিদেশি যারা কোচ হিসেবে ছিলেন তাদের মধ্যে কেবল ইভান রাজলগই রয়েছেন।

বিগত দিনে বিদেশি কোচ নিয়োগের বিষয়টি বাফুফে যেভাবে করে আসছিল তা নানা কারণেই প্রশ্নে জন্ম দিয়েছিল। সঠিকভাবে মান যাচাই না করেই একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হতো। এরপর কোন টুর্নামেন্টে অংশ নিতে গিয়ে ফলাফলও হয়েছে উল্টো। কোচরা বাংলাদেশ দিয়ে তাদের জাতীয় দলের যাত্রা শুরু করে থাকেন।

যেমন করে জেমি ডে করেছেন আর সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া কাবরেরাও হেটেছেন একই পথে। কিছুটা বিলম্বে হলেও এবার বাফুফের বোধদয় হয়েছে। গত এক যুগেরও বেশি সময় দেশের জাতীয় দল গঠন আর অপ্রয়োজনে বিদেশি কোচিং ষ্টাফ নিয়োগ করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আর সে কারণেই সাফল্যের খাতা থাকে শূন্য।

বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ধারাটা এবার পরিকল্পনায় বদলে গেছে। বিদেশি কোচের সঙ্গে অনেকটা নতুন আঙ্গিকে যোগ করা হয়েছে নতুন দেশি ষ্টাফ। পুরুষ দলের পাশাপাশি নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলেছেন কোচ কাবরেরা। তাদের সাফল্যের কথা জেনে দারুন খুশি হয়ে তিনি বলেছেন, সঠিক পথেই রয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল। জাতীয় দলের জন্য বিদেশি স্টাফের প্রয়োজন দেখছেন না নতুন এই কোচ।

কিছুটা ধীরে হলেও বাংলাদেশকে একটি ‘হাই পারফরম্যান্স’ দল বানাতে চান কাবরেরা। শুন্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে হাই পারফরম্যান্স দলের রূপ দেওয়ার পকিল্পনা নিয়ে কাবরেরা বলেন, ‘বাংরাদেশের ফুটবলকে আমি শুন্য থেকে শুরু করতে চাই। একটি দলে বিভিন্ন প্যারামিটার থাকে আর সেগুলো ধীরে ধীরে তৈরি করবো। হাই পারফরম্যান্স দল গঠনের জন্য মেডিকেল, সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয় করেই করা হবে।’

আবাহনী, উত্তর বারিধারায় গিয়ে কোচ বিশেষ কিছু বলেননি। পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি কুশল বিনিময় করেছেন।

পাশাপাশি বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে ফুটবলারদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকেও লক্ষ্য বানিয়েছেন এই কোচ, ‘বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড়রাই জাতীয় দলে খেলে থাকেন। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যে কোন সময়ের চেয়ে উন্নয়ন করতে চাই। তাই ক্লাবে ক্লাবে পরিদর্শন করা খুব ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি।’

নতুন কোচের সামনে তাই নতুন চ্যালেঞ্জ এবার। নিয়মিত বিপিএল ফুটবলের ম্যাচ দেখার পাশাপাশি ক্লাবগুলোর কোচিং টেকনিকও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রথমবারের মতো কোনো জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার চ্যালেঞ্জটা অনেকটা ইচ্ছে করেই কাবরেরা নিয়েছেন, ’আমি বাংলাদেশ দলের কোচ হয়ে চ্যালেঞ্জটা নিতে নিজেকে তৈরি করেছি।’

ভারতীয় ক্লাব স্পোর্টিং গোয়াতে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর আগে। সেই সূত্র ধরে দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে বলেই তাকে লাল সবুজ কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামী মার্চে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ফুটবলার নিয়ে কাজ শুরুর আগে একটা ধারনা নিতে চান বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে। খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখতে চান কাবরেরা।

এদিকে নতুন কোচের কাছে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের কিছু চাওয়া রয়েছে। নতুন কোচের সঙ্গে চুক্তির আগে আলোচনা শেষে বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘নতুন কোচের সঙ্গে একাধিক বিষয় নিয়ে আলাপ করে আমার ভালো লেগেছে। আমি কোচের কাছে খুব বেশি নয়, একটা জিনিসই চেয়েছি। আমরা অনেক বছর ধরেই প্রায় ম্যাচেই শেষ চার/পাঁচ মিনিটে গোল খেয়ে হেরে যাই। এটা বন্ধ করে ম্যাচে জয় এনে দেওয়ার কথাই আমি কোচকে বলেছি।’

নিজের চাওয়ার কথা আগেভাগেই বলে দিয়েছেন। এদিকে নতুন স্প্যানিশ কোচ কাবরেরাকে শুভকামনা জানিয়েছেন জেমি ডে। চুক্তি থাকার পরও কোচের ভূমিকায় না থাকলেও কাবরেরাকে শুভকামনা জানাতে কার্পণ্য করেননি জেমি। এমনিতে দায়িত্বে না থাকলেও বাফুফের সঙ্গে চুক্তি বর্তমান আছে এই ইংলিশ ম্যানের। হয়তো বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই তার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত জানাতে পারবে বলে আভাস মিলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link