১৯৯৬। ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর। ইডেন টেস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ৩২৯ রানে হেরে গিয়েছিল ভারত।
সেই টেস্টের শতরানটাই ছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের সেরা শতরান, আমার মতে। ১৮টা চার আর ১টা ছয় ছিল তার ৭৭ বলে ১০৯-এর মধ্যে। প্রথম ৫০ এসেছিল ৫৭ বলে, পরের ৫৯ করেছিলেন ২০ বলে। তার মধ্যে ১৫টা চার মেরেছিলেন ক্লুজনারকে, যিনি ১৪ ওভারে দিয়েছিলেন ৭৫ রান।
৭/১৬১ থেকে অষ্টম উইকেটের জুটিতে অনিল কুম্বলেকে নিয়ে তিনি যোগ করেছিলেন ১৬১ রান, ভারত প্রথম ইনিংসে করেছিল ৩২৯ রান। দ্বিতীয় ইনিংসেও দলের ১৩৭-এর মধ্যে অধিনায়কের ছিল নয়টি চারসহ ৫৫ বলে ৫২ রান।
কবজির জাদুকর তিনি টেস্ট খেলার সংখ্যার সেঞ্চুরি পাননি একটি টেস্টের জন্য। আর ব্যাটে ২২টি শতরান পেলেও একটিও দ্বি-শতরান পাননি ১ রানের জন্য। এটাই হয়ত ক্রিকেট দেবতার ‘বিচার’ ছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের অপ্রমাণিত ‘অক্রিকেটীয় ঘৃণ্য খেলার’ বিরুদ্ধে।
‘কবজির আমি কবজির তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’ সত্যিই তাই ছিল এটা তার ক্ষেত্রে। সব ছাড়িয়ে তার কবজির মোচড়টাই নির্ণায়ক করে দিয়েছিল তার ব্যাটিংকে। কি অনায়াসে তার কবজির মোচড়ের সঙ্গে সাড়া দিত তার ব্যাট আর ওদিক থেকে ধেয়ে আসা পেস আর স্পিন, তা যারা দেখেছেন, তারাই জানেন। আর যারা তা দেখেননি, তাদের এটা বলে বোঝানো এক রকম অসম্ভব।
স্মৃতির পোশাকে ঢাকা সেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতিই, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। স্কোয়ার লেগ আর ডিপ ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে বলকে পৌঁছে দেবার ট্রাভেলিং এজেন্ট ছিল তার কবজির ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া ফ্লিক আর পুশ গুলি। অফের দিকে তাঁর করা কভার ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাট গুলি এবং অনের দিকে করা পুলগুলিতেও লেখা থাকত অপার সৌন্দর্য ঠিকানা।
ডিসেম্বর ১৯৮৪ থেকে ইডেন থেকেই শুরু হয়েছিল ১৫ বছরেরও বেশি স্থায়ী তার ৯৯ টেস্টের ক্যারিয়ার (হিরো কাপ, ১০৭.৫০ গড় ও ৫টি শতরানসমৃদ্ধ যে ইডেন তাকে কখনোই খালি হাতে ফেরায়নি, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ছাড়া) আর ওই সিরিজেই পরপর তিনটি শতরান দিয়ে শুরু হয়েছিল তার টেস্ট ক্যারিয়ার।
ইডেনে ১১০, মাদ্রাজে ১০৫ আর কানপুরে ১২২। ৯৯ টেস্টে ২২টি শতরান আর ২১টি অর্ধশতরানে সাজানো ছিল তার ৬২১৫ টেস্ট রান (সর্বোচ্চ ১৯৯)। দক্ষ ফিল্ডার তিনি টেস্টে ক্যাচ ধরেছেন ১০৫টি।
১৯৮৫ থেকে ২০০০, ৩৩৪টি ওয়ানডে ১২টি উইকেট নেওয়া তিনি ওডিআই ক্যাচ ধরেছেন ১৫৬ টি। তার ওয়ানডে রানসংখ্যা ৯৩৭৮ (সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৫৩), সাতটি শতরান আর ৫৮টি অর্ধশতরান দিয়ে যা সাজানো ছিল। আর ২২৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তার রান, উইকেট আর ক্যাচ সংখ্যা ছিল ১৫৮৫৫ (৫৪টি শতরান আর ৭৪টি অর্ধশতরান), ১৭ আর ২২০।
ক্রিকেটে তার মত উচ্চ শিখর (১৯৯২, ১৯৯৬ আর ১৯৯৯ – তিনটি বিশ্বকাপে অধিনায়ক কিন্তু কোনটাই জেতেননি, জিতেছেন ১৯৯৩ সালের হিরো কাপ, ১৯৮৫ সালের বেনসন হেইজেস কাপসহ অসংখ্য কাপ ও ট্রফি) ছুঁয়ে একেবারে গভীর তলানি (গড়াপেটার গ্লানিতে ২০০০ সালে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে তাৎক্ষণিক বিস্মরণে চলে যাওয়া) দেখে ফেলার নিরিখে আর কেউ আছেন কিনা, সন্দেহ।
জীবনেও বোধহয় এটাই তার ভবিতব্য ছিল। ২০১১ সালে এক দুর্ঘটনায় কনিষ্ঠ পুত্রকে হারান বিবাহিত জীবনে টালমাটাল পথে হাঁটেন তিনি। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘আজহার’। তাঁকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রেরও একই নাম।