মাহির চোখে জল, সময়ের সুতোয় দুলছে সাদা বল

প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের ভিড়। সন্ধ্যে সাতটায় আসার কথা তাঁর। এলেন না৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে যাওয়া ভুয়ো খবর হোক কিংবা অজানা আশংকা - সব মিলিয়ে সন্ধ্যে সাতটা ভারতের মাহেন্দ্রক্ষণ হয়ে গেল যেন। তিনি এভাবে সরে যাবেন? রাঁচির টিকিট কালেক্টর ছেলেটা যেদিন প্রথম ব্যাট হাতে তুলে নেয় সেদিন যেন কেউ বলেছিল- ‘যাব তক বাল্লা চলেগা, তাব তাক ঠাঁট চলেগা...', মাহি অধ্যায়ের শেষ পাতার রোমাঞ্চ দোলা দিচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল।

১.

তিনকোনা ইটগুলো একটা সীমানা এঁকে দিয়েছে। দুদিকে মাটি থেকে মাথা উঁচু করে থাকা ইটের সারি রাস্তার কাঠামো বানিয়েছে ৷ মাটির রাস্তা সোজা চলে গেছে পোড়ো বাড়িটার দিকে। জংলা ঘাসে ঢেকে আছে পথ। কতকাল সাফ হয় না। বাড়ির ফটকে পাথরের ফলকটা কোণা থেকে ভাঙা। শ্যাওলা জমা তুলসী মঞ্চে আধভাঙা মোমবাতি ৷ ভেতর থেকে ঘড়ঘড়ে রেডিওর শব্দ।

বাইরে গ্রামের কটা ছেলে এসে জুটেছে। বুড়ো মধুসূদন টিভি খুলেছে। বাড়ির মালিকরা বিলেতে বহুকাল। গাঁয়ের তিন পুরুষের ভিটে এখন পুরোনো চাকর মধুর জিম্মায়৷ এত বড় বাড়ির এক কোণে ছোট্ট ঘরে মধু থাকে৷ ভারতের খেলা থাকলে রেডিও ছেড়ে দেয়। মাঠের থেকে ছেলেরা এসে জোটে ওর ঘরের জানলায়৷ গাঁয়ে বারুজ্জে বাড়িতেই রেডিও আছে।

উদাম গা, পায়ে কাদামাখা ছেলের দল, মধু বিস্কুট দেয় খেতে ওরা একমনে শোনে রেডিওর কমেন্ট্রি। শচীন ব্যাট করলে যারা এসে জুটত এখন তারা সব চাষের কাজে লেগে গেছে, এখন এরা আসে। চারপাশের বাড়ির শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসে, তুলসীমঞ্চে আলো জ্বলে গাঁয়ের সব ঘরে, বারুজ্জে বাড়ির নীচের ঘর থেকে ভেসে আসে- ‘মাহি মার রাহা হ্যায়, ঔর এক লম্বা ছক্কা ভারত কে লিয়ে, মহেন্দ্র সিং ধোনি…’

ঘরের বাইরে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ছেলের দল। মধুর মনে পড়ে শচীনের কথা, ছোটোকত্তার ব্যাট দেখতে এমনই ভিড় জমত এককালে।

২.

সুমনের গানের মতোই দশফুট বাই দশফুট ঘর। মায়ের ঠাকুর পূজোর খুপরি এক কোণে। আলনায় টাঙানো অল্প ছেঁড়া স্যান্ডোটা গলিয়ে একটা ধূপ জ্বালিয়ে আলমারির সামনে ঘোরাতে লাগল শুভ। ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে অবয়ব। লম্বা লম্বা চুল গুলো নিয়ে হাসছেন তিনি, হাতে বি এ এস ব্যাট। শুভ আজও ধূপ দেখায় সন্ধ্যায় তাঁর ঈশ্বরকে।

সাত বছর আগে রথের মেলা থেকে কেনা ফটোটা, একটা ফ্রেমে বাঁধানো রঙিন ছবির শখ বহুদিনের। হয়ে ওঠেনি আর। চুলটা বাড়িয়েছিল কিছুদিন, কাঁধের কাছে সেলাই খোলা মাহির জার্সি পরে পাড়ার মাঠে নামলে সবাই শুভমাহি বলে খ্যাপাতো। এখন টিউশানি পড়ানোর চাপে মাঠে খেলতে যাওয়া হয় না। পরের মাসে মাইনে পেলে একটা ৭ নম্বর জার্সি কিনবে। শার্টটা গলিয়ে বেরিয়ে গেল শুভ।

৩.

প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের ভিড়। সন্ধ্যে সাতটায় আসার কথা তাঁর। এলেন না৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে যাওয়া ভুয়ো খবর হোক কিংবা অজানা আশংকা – সব মিলিয়ে সন্ধ্যে সাতটা ভারতের মাহেন্দ্রক্ষণ হয়ে গেল যেন। তিনি এভাবে সরে যাবেন? রাঁচির টিকিট কালেক্টর ছেলেটা যেদিন প্রথম ব্যাট হাতে তুলে নেয় সেদিন যেন কেউ বলেছিল- ‘যাব তক বাল্লা চলেগা, তাব তাক ঠাঁট চালেগা…’, মাহি অধ্যায়ের শেষ পাতার রোমাঞ্চ দোলা দিচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল।

বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে শূণ্য রানে রান আউট থেকে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ২ ইঞ্চির তফাতে ছিটকে যাওয়া স্টাম্প একটা অখণ্ড সোনালি রেখা, এক অনন্ত রানিং বিটউইন দ্যা উইকেটস, দুই উইকেটের মাঝে ক্রিকেটীয় ধর্মের দেশে গ্রাম থেকে শহরতলির উজান যাত্রা, শচীন মহিমার পরবর্তী ভারতের আঁকড়ে ধরার শক্ত হাত।

‘শচীন আছে এখনো ? তাহলে জিতব…’ থেকে ‘মাহি শেষ ওভার অবধি খেলুক জিতে যাব’-তে একটা ভারতীয় প্রজন্মকে উন্নীত করে দেওয়া ম্যাজিশিয়ান।

সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে রইলেন। মাহি ব্যাট হাতে অনন্ত আকাশের নীচে ক্রিজে দাঁড়ান। ক্রিজে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে যোগিন্দর শর্মার কথা, মনে পড়ে সেদিনের সেই শ্রীসান্থকে প্লেস করার ডিসিশনটা, মনে পড়ে ভারতের হাত থেকে ফসকে যাওয়া একটার পর একটা সুতো চক্রের মতো নিজের আঙুলে টেনে নিয়েছেন তিনি, তাঁর সিংহাসনে বেড়েছে আভরণ, তাঁর মুকুটে জুড়েছে পালক, তাঁর মাঠে হেঁটে বেড়ানো হয়েছে প্রতিপক্ষের কাছে মাসাইমারার জঙ্গলে সিংহের নিঃশ্বাসের মতো।

বোলার ক্রমশ এগিয়ে আসছে, মাহি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ঘন্টা, ক্রিকেট ঈশ্বর যেন দুহাত মেলে তাকে ডাকছেন, সেদিনের সেই ছেলেটা যাকে একদিন সৌরভ জেদ করে নিয়ে এসেছিল দলে সে-ই ছোট্ট চারাগাছ এতগুলো বছর ভারতীয় ক্রিকেটকে দিল বনস্পতির ছায়া, বোলারের চোখে চোখ রাখলেন ভারত ভাগ্যবিধাতা, বুকের তেরঙা পতাকাটা যেন খামচে ধরছে শরীর, এই নীল জার্সি অতীত হতে চাইছে না চেনা শরীরটা ছেড়ে, বলটা ড্রপ খেয়ে এগোলো মাহির দিকে- মাহি চোখ বুজে ব্যাট তুললেন- বন্ধ চোখের ভেতর খেলা করছে ২০১১ বিশ্বকাপ, ২০০৭ বিশ্বকাপ,ভারতের ১ নম্বর র‍্যাংকিং, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়কের তকমা।

যেভাবে স্টাম্প ছিটকে দিতেন উইকেটের পিছনে এতকাল সেভাবেই চোখ মেললেন, শেষবার ব্যাটের মাঝখানে লাগল বলটা, চেনা শব্দ- আকাশের দিকে তাকালেন মাহি, বলটা একটু একটু করে আলো জ্বেলে দিচ্ছে অন্ধকার আকাশটাতে, সেখান থেকে স্পষ্ঠ হচ্ছে অবয়বগুলো, সৌরভ-শচীন-তাঁর প্রাণের বন্ধু যুবি-বীরু-জাহির আরও কত সহযোদ্ধা হাত নেড়ে ডাকছে তাকে, মাহির চোখের কোনে জল, সময়ের দুর্লঙ্ঘ সুতোয় দুলছে সাদা বলটা, চারদিক থেকে গাঢ় হচ্ছে চিৎকার- ‘ধোনি ধোনি ধোনি…’

ক্রিকেট বিশ্বের শেষ মহাকাব্যের পাতা পড়ে ফেলছেন অজপাড়াগাঁয়ের মধুসূদন, মফঃস্বলের শুভ- আমাদের রাত গাঢ় হচ্ছে ,মালকোষ রাগ চলে যাচ্ছে বিস্তারে, তাতে জমা হচ্ছে চুইয়ে পড়া স্মৃতি- গ্রাম থেকে মফঃস্বল হয়ে শহরের ট্রাপিজের সুতো দিয়ে খোলা আকাশে ভাসছে ক্রিকেট মহাকাব্যের শেষপাতা, আমাদের কৈশোর থেকে যৌবনে খেলে বেড়াচ্ছে ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল আর একটা কোরাস- মাহি! মাহি! মাহি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...