তাঁর দলের সব সদস্যের সই করা একটা চিঠি পেয়েছিলেন বিষ্ণু সোলাঙ্কি, বারোদা থেকে ভূবনেশ্বর ফিরে আসার পরে। কী লেখা ছিল তাতে? সম্ভবত ক্রিকেট নামের এই খেলাটার প্রতি এবং নিজের দলের প্রতি বিষ্ণুর দায়বদ্ধতা নিয়ে সহ-খেলোয়াড়দের মুগ্ধতা ধরা ছিল সেই চিঠিতে।
বিষ্ণু যখন দলের সঙ্গে ভুবনেশ্বরে রঞ্জি ম্যাচ খেলার জন্য , ঠিক তখনই কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা হবার খবর এসে পৌঁছেছিল তাঁর কাছে। তারিখটা এগারোই ফেব্রুয়ারি। চব্বিশ ঘন্টাও থাকা হয়নি সেই শিশুর পৃথিবীতে। ভূবনেশ্বরে বসেই এই যন্ত্রণার খবর পান তিনি। ফিরে যান শেষকৃত্য করতে। বাংলা – বারোদা ম্যাচ তাই খেলা হয়নি বিষ্ণু সোলাঙ্কির। কিন্তু ফিরে এসেছিলেন বরোদা– ছত্তিশগড় ম্যাচ খেলতে।
আর তাই-ই তাঁর ‘কমিটমেন্ট’-কে কুর্নিশ জানিয়ে বরোদায় তাঁর সতীর্থদের ওই চিঠি। কিন্তু বিধাতা তখনো বিষ্ণুর সহখেলোয়াড়দের এবং আমাদের জন্য ও বিস্ময়ের মোড়ক টা পুরো খোলেননি । ম্যাচের প্রথম ইনিংস এ সেঞ্চুরি করেন বিষ্ণু সোলাঙ্কি। পাঁচ নম্বরে নেমে। সন্তানশোক উনত্রিশ বছরের এই ক্রিকেটারের ‘ফোকাস’ এ এতটুকুও টোল ফেলতে পারেনি।
ঠিক তার কিছুক্ষণ আগেই অসাধারণ ফিল্ডিং করে একটা নিশ্চিত চার বাঁচিয়েছেন বিষ্ণু। এবং তখন ই বরোদা টিম ম্যানেজার ধর্মেন্দ্র আরোঠে ডেকে নেন বিষ্ণুকে, দেন সেই চরম দু:সংবাদ। সদ্যোজাত কন্যার পরে এবার বাবা। দুই মাস ধরে রোগ ভোগের পর তিনিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। আমরা কখনো জানতে পারব না , সেই মুহূর্তে বিষ্ণুর মনোজগতে কী ঘটেছিল। কিন্তু যাই ঘটুক তাকে নিজের ‘কমিটমেন্টের’ ওপর যেতে দেননি বিষ্ণু।
বারোদা ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে ম্যানেজার আরোঠে এবং বারোদা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন প্রধান অজিত লেলে। কিন্তু বিষ্ণু ফেরেন নি। ড্রেসিংরুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভিডিও কলে বাবার শেষ কৃত্য দেখেন তিনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারোদা অধিনায়ক কেদার দেওধরের গলায় শুধুই শ্রদ্ধা, শুধুই বিস্ময়, শুধুই মুগ্ধতা! এতদিনের চেনা টিমমেট কে যেন অচেনা লাগছিল দেওধরের!
এমন নয় যে বিষ্ণুই প্রথম। একটু পেছনে তাকালে বিরাট কোহলি, মোহাম্মদ সিরাজ বা আরেকটু পেছনে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার ও দেখিয়েছেন প্রায় একই রকমের দায়বদ্ধতা।
বিষ্ণু সোলাঙ্কি, বয়েস উনত্রিশ, বারোদার হয়ে রঞ্জি বা মুশতাক আলী খেলেই হয়তো শেষ হবে তাঁর ক্রিকেটজীবন। এই ঘটনাটা না ঘটলে সেই ভাবে কখনো প্রচারের আলোয় আসাই হতো না তাঁর, আমাদের ও জানা হতো না বারোদার পাঁচ নম্বর ব্যাটারের কথা। কখনো একটা, দুটো সেঞ্চুরি হয়তো খবরের কাগজে দু-এক লাইন জায়গা দিত তাঁকে, হয়তো নয়!
ক্রিকেটারদের বেশি টাকা পাওয়া নিয়ে সোচ্চার হই আমরা। কখনো , কখনো বেটিং বা ফিক্সিংয়ের মত জিনিস প্রাচীন এই খেলাটার বিশ্বাসের শিকড় ধরেই টান দেয়! ঠান্ডা ঘরের আরামে বসে খেলটাকে এবং খেলোয়াড়দের ফালাফালা করে দিয়ে এক চরম আত্মতৃপ্তি লাভ করি আমরা।
আর ঠিক তখনই বিষ্ণু সোলাঙ্কিরা আসেন। আসেন প্রমাণ করার জন্য যে ক্রিকেট শুধু দেয় ই না, নেয় ও কখনো , কখনো। এবং সেই অভিঘাত সামলেও বিষ্ণু সোলাঙ্কিরা ব্যাট তোলেন। আমরা মাথা নোয়াই তাঁর ক্রিকেট – ভালোবাসার কাছে। আর হয়তো সকলের অলক্ষ্যে মাথা নোয়ান স্বয়ং ক্রিকেট দেবতাও!