ব্রায়ান লারা তাঁর ক্যারিয়ার শেষে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আমাদের। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের যথেষ্ট বিনোদন দিতে পেরেছি?’
প্রশ্নটা অবান্তর। অনেকটা আইন্সটাইন বুদ্ধিমান ছিলেন কিনা এই টাইপ প্রশ্নের মত। যে মানুষটার ব্যাটিং ছিল দৃষ্টি উপভোগ্য, সেই মানুষের ব্যাটিং থেকে বিনোদন নিতে না পারার প্রশ্নে উত্তর নেতিবাচক হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরে ফিরে আসছে অন্য একটা কারণে।
শাহরিয়ার নাফিস নিজের ফেসবুক পেজে বলেছেন, সাকিবের ওয়ানডে খেলা আর তাসকিনের আইপিএল না খেলা দুটোই নাকি সাহসী সিদ্ধান্ত। নাফিস সাহসী বলেছেন, বাকি সবাই বলছে আরেক কাঠি সরেস মাখিয়ে। তারা বলছে, তাসকিনের আইপিএল না খেলা আর সাকিবের তৃতীয় ওয়ানডে খেলা সবই চূড়ান্ত দেশপ্রেমের পরিচয়। ব্যাপারটা কি আসলেই এমন?
ক্রিকেটকে উপমহাদেশে যেভাবে বিবেচনা করা হয়, বেশিরভাগ দেশই এভাবে ক্রিকেটকে নেয়না। তাদের সবার কাছে ক্রিকেট দুইরকম। যারা ক্রিকেট খেলে তাদের কাছে একটা পেশা, আর যারা খেলে না তাদের কাছে একটা বিনোদন। এই দুইয়ের বাইরে এর সাথে সমাজ, রাজনীতি কিংবা দেশপ্রেম মেলানোর আসলে কোন সুযোগ নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বারবারই এটাই করা হয়। আর এসবের বলি কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়না, হয় ক্রিকেটাররা।
একজন ক্রিকেটার হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, দিনের পর দিন রক্ত পানি করে তারপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান। ভুল বললাম আসলে, সবাই যে পান তাও নয়, কেউ পান। আবার কেউ পান না। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে সবাইকেই অনেক চড়াই উৎরাই পার করতে হয়। একজন ক্রিকেটার এসব কেন করেন? দেশপ্রেম থেকে?
নাহ। নিজের ভালবাসা থেকে, আর এই ভালবাসা থেকে একটা পেশাতে স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করার জন্যে। কিন্তু বারবারই দেখা যায়, শাহরিয়ার নাফিসের মত গুটিকয়েক লোক এসবের ঘোল খাইয়ে ক্রিকেটের সাথে দেশপ্রেম জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এদের থেকে সাবধান থাকাই ভাল। কলোনিয়াল যুগকে বাদ রেখে বলছি, ক্রিকেটের সাথে দেশপ্রেমের কোন সম্পর্ক নেই, কোনদিন ছিলই না।
এসব বললে অনেকে অবশ্য গ্রায়েম স্মিথের ঐ ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটে নেমে পড়া কিংবা তামিমের সেই স্লিংয়ে ঝুলানো হাতের ছবি দেখান। এসব কি তাহলে দেশপ্রেম না? উত্তর হল , হ্যাঁ। এসব তারা দেশপ্রেমের জন্যই করেন, খেলার প্রতি নিবেদন থেকেই করেন। কিন্তু এই কাজটা প্রতিটা পেশার মানুষই করতে পারেন। ধরেন, একজন অফিস ওয়ার্কার অফিস ডিউটি শেষ করতে বা বড় কোন প্রজেক্টের জন্যে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে অফিসে এল।
এরপর আরো ঘন্টাখানিক বেশি কাজ করল। আপনি কি তামিমের ঐ ঘটনাটার মত করে এটাকেও প্রায়োরিটি দেন? দেন না। সমস্যাটা এখানেই। দুটোই সমান এবং দুটোই তারা করেছেন কাজের প্রতি ভালবাসা থেকে, দেশপ্রেম থেকে। দেশপ্রেম প্রমাণের জন্যে তাই আপনাকে শুধু ক্রিকেটেই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নেমে পড়তে হবে এমন নয়। এটার প্যারামিটার শুধুই ক্রিকেট না। আর এখানেই সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা এসে যায়, তাহলে ক্রিকেটে দেশপ্রেম অবান্তর কেন বলছি?
কারণ, শুধু ক্রিকেটেই না। যেকোন কাজেই এই নিজের অসুস্থতা ব্যতিরেকে কিংবা পরিবারকে সময় না দিয়ে কাজ করাটা একটা ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত । মোটেও কম্পুলসারি না। মানে, করলে ভাল। না করলেও ক্ষতি নেই। গ্রায়েম স্মিথ যদি ঐদিন ভাঙা হাত নিয়ে না নেমে পড়তেন কিংবা তামিম যদি স্লিংয়ে বাঁধা হাত নিয়ে লাকমালকে না সামলাতেন, তাতেও তাদের একটুও দোষারোপ করা যেত না।
তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত না। কারণ এটা তাদের ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত। তারা ইচ্ছে হলে করবেন, না হলে করবেন না। একজন ক্রিকেটারের কাছে ক্রিকেট একটা পেশা, যেমন একটা দিনমজুরের কাছে সকালে উঠে শ্রম দিতে যাওয়ার একটা পেশা। এসবের বাইরে ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম ঢোকানোর কোন সুযোগই নেই।
ক্রিকেটকে দেশপ্রেম দিয়ে এই যে এই অঞ্চলে ফ্যান্টাসাইজ করা হয়, এর কারণ কিন্তু একদম ইকোনমিক্যাল। ক্রিকেটকে যেভাবে এই দেশগুলিতে পূজনীয় মানা হয়, অন্য কোন দেশেই এমনটা করা হয়না। আর তাই ক্রিকেটের বড় বড় সব স্পন্সরদের মধ্যমণি হয়ে থাকে এই উপমহাদেশ। এসব ঘটনার শুরু হয়েছে নব্বই দশক থেকে।
ঐ সময়ই বড় বড় সব স্পন্সররা সাউথ এশিয়ার ক্রিকেটে ইনভেস্ট করতে শুরু করে। কারণ তারা দেখেছে, এই অঞ্চলের মানুষকে ক্রিকেটের নামে দেশপ্রেম গুলিয়ে খাওয়ানো যায়। ক্রিকেটকে তারা অন্যান্য সব মহাদেশের চাইতে অনেক বড় কিছু মনে করে। আর তাই ক্রিকেট মিশায়ে দেশপ্রেমের এই ক্রেজ স্পন্সরদের দোহাইতেই দিনের পর দিন বেঁচে আছে এই অঞ্চলে।
এসবের কিন্তু সাইড ইফেক্টও আছে। এই যে ক্রিকেট আর দেশপ্রেম মিলায়ে একটা ভয়েড জায়গা এই দেশে আছে বলেই মাশরাফি বিন মুর্তজার কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের মত একেকজন খেলোয়াড় একাদশে এত লম্বা সময় ধরে থাকেন। ক্রিকেটে দেশপ্রেম কন্সিডার করা হয় বলেই তারা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষেও বড় সময় প্রিমিয়ার লিগগুলিতে দল পান।
এমনিতে মাশরাফির যে ফিটনেস, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর থেকেই দলে তার জায়গা অবান্তর হয়ে যাওয়ার কথা, উনিশ বিশ্বকাপের দলের আশেপাশেই থাকার কথা না তার। তবুও তিনি দলে ছিলেন, বাজে ফিটনেস নিয়ে ম্যাচ খেলেছেন। কারণ প্রথমত অবশ্যই দেশপ্রেমের ধোয়া। এই ধোয়া যতদিন আছে ততদিন আবেগ বেঁচে ক্রিকেট খেলা খেলোয়াড়েরা দলে থাকবেনই। আর এই আবেগ টিকিয়ে রাখাটা ক্রিকেটের বানিজ্যিকরণের স্বার্থেও জরুরী। শচীনও একই ভাবে ২০১১ সালের বিশ্বকাপটা জিতেই বিদায় বলে দিতে পারতেন। তবে, তিনি বলেননি, চালিয়ে গেছেন। লম্বা করেছেন নিজের ক্যারিয়া।
ক্রিকেটে দেশের প্রতিনিধিত্ব হয়। ফলে, দেশপ্রেম একদমই যে নেই তা না, তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে এটা নিতান্তই একটা পেশা। আপনার অফিস কি রিটায়ারের বয়স পার করা কর্মীদের অফিসে রাখে? আনস্কিলড ওয়ার্কারদের বেতন দেয়? কিংবা পুরানো দিনে কি করেছে সেসব বিবেচনায় নিয়ে এখনকার সময়ে ভাল আউটপুট দিতে না পারা লোকদের অফিসে পুষে রাখে? রাখেনা। তাহলে ক্রিকেটে এসব কোথা থেকে আসছে? কি করে হচ্ছে? কারণ ক্রিকেটকে দেশপ্রেমের একটা প্যারামিটার হিসেবে ধরা হয়ে গেছে। এই প্যারামিটার থেকে বের না হলে এটাকে ‘পেশা’ হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
আর সেজন্যই, সাকিবের অসুস্থ পরিবার রেখে ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া হয়তো বাহবা দেওয়ার মত ব্যাপার। কিন্তু কোনভাবেই সাহসী সিদ্ধান্ত না, দেশপ্রেম না। তিনি খেলাটাকে ভালবাসেন, দলকে জিততে দেখতে চান, তাই ক্রিকেট খেলছেন। এটা খেলাটার প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট।
একই কথা তাসকিনের জন্যেও প্রযোজ্য। একজন খেলোয়াড় খেলেনই মাত্র কয়েকদিন, তার মধ্যে যত বেশি সম্ভব আয় করে নিতে হয়। সেখানে আইপিএল একটা বড় মওকা। তাসকিন জাতীয় দলের ডিউটি রেখে সেখানে যাননি, তার জন্যে তাকে আমরা ধন্যবাদ দিতে পারি। কিন্তু মোটেই কোন উদাহরণ মানতে পারিনা। কারণ তিনি যদি যেতেও চাইতেন, তবুও আমরা তাকে বাঁধা দিতে পারতাম না।
তিনি যাননি কারণ একটা সিরিজের আগে দলের একটা প্লেয়ার নিয়ে পরিকল্পনা থাকে, তাসকিনকে নিয়েও দলের অমন একটা পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা রেখে হুট করে যাওয়া তাসকিন সমীচিন মনে করেন নি। এটা প্রশংসার ব্যাপার। কিন্তু যদি যেতেন? তাসকিনের দেশপ্রেম নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারতাম? পারতাম না। এখানে দেশপ্রেম ব্যাপাটাই আনভ্যালিড একটা প্রশ্ন।
ক্রিকেট মিশিয়ে দেশপ্রেম গেলানো সবার থেকে তাই সতর্ক থাকুন। এরা ক্রিকেটের জন্যে ক্ষতিকর।