লাহোর ক্রনিকাল: ইতিহাস ও হৃদয় জয়

পঞ্চম দিনের শেষ সেশনের খেলা। লাহোরের তপ্ত গরম আর শেষ বিকেলের সূর্য তখন যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য এই গরম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের গায়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের দাপটে পুড়ছে পাকিস্তান! জয় পেতে অজিদের দরকার মাত্র এক উইকেট। অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স তখন বোলিংয়ে আনলেন মিশেল সোয়েপসনকে। ঘণ্টা কয়েকের মাঝে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম ওভার।

হয়তো কামিন্স চেয়েছিলেন দুই কিংবদন্তি লেগ স্পিনারের নামে হওয়া এই সিরিজটার সমাপ্তি লেগ স্পিনারের হাত ধরেই হোক। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নকে শ্রদ্ধা জানাতে! হয়তোবা কামিন্স চেয়েছিলেন দলের সবচেয়ে আনকোরা বোলারকে দিয়েই শেষ উইকেট নিয়ে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিতে।

তবে না এর কোনোটাই হয়নি! মিড উইকেট থেকে হঠাৎ দৌড়ে এসে সোয়েপসনকে ক্যাপ ফিরিয়ে দিয়ে বোলিংয়ে কামিন্স। ডেপুটি অধিনায়ক স্টিভ স্মিথও যেন সায় দিচ্ছেন কামিন্সের সিদ্ধান্তে। অধিনায়কের হাত ধরেই আসুক ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়টা।

১৫ দিন ধরে টেস্টে ফলাফল দেখেনি অস্ট্রেলিয়া! পাকিস্তানের পাটা উইকেটে নির্বিষ টেস্ট খেলে হাপিয়ে উঠেছে অজিরা। শেষ টেস্টের শেষদিনে তাই এই শেষ উইকেট জয়ের আগাম ইঙ্গিত। জয় থেকে তখন মাত্র এক হাত দূরে অজিরা।

এখনই সময় অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই অধ্যায় গড়ার। অবশ্য আর মাত্র ছয় বলের মতো টিকে ছিলো পাকিস্তানের শেষ উইকেট জুটি। নাসিম শাহকে বোল্ড করে ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া! প্যাট কামিন্সকে জাপটে ধরে অজিদের বাঁধভাঙা উল্লাস। ফাইন লেগ থেকে দৌড়ে এসে কিছু সেকেন্ড বাদেই এই উদযাপনে যুক্ত হন নাথান লিঁও।

যদি কামিন্স অস্ট্রেলিয়াদের এই অবিস্মরণীয় ভ্রমণের নায়ক হয়ে থাকেন তাহলে লিঁও এমন একজন যিনি কামিন্সকে সাহায্য করেছে এই ভ্রমণের স্মৃতি আরও মধুর করতে। একটা টেস্টের শেষদিনে একজন অধিনায়ক ও স্পিনারের সম্পর্কটা একেবারেই অন্যরকম। এখানে থাকে আস্থা, থাকে ভরসাও। গেলো ১৪ মাসে অধিনায়কের আস্থার পূর্ণ প্রতিদানই দিয়েছেন লিঁও। চতুর্থ ইনিংসে যখনি দল বিপদে তখনি বল হাতে সেরাটা দিয়ে ম্যাচ নিয়ে এসেছেন নিজেদের পক্ষে।

এই লিঁও সপ্তাহ খানেক আগে করাচিত স্টেডিয়াম ত্যাগ করেছিলেন বিষন্ন মনে। লিঁওর চোখের সামনে পাঁচ দিনের টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বল খেলে টেস্ট বাঁচিয়ে নিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু লাহোর টেস্টে যেনো আগ্রাসী এক লিওকে দেখা গেলে।

এজ হচ্ছে, টার্ন করছে – পাকিস্তানি ব্যাটারদের জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠেন তিনি। স্লিপে স্মিথ, শর্ট লেগে ডেভিড ওয়ার্নার, সিলি পয়েন্টে মার্নাশ লাবুশেনরা ক্যাচ মিস করায় লিঁওর বলেই কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া হয়! টানা দুই বলে দুই সুযোগও তৈরি করেন লিও। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় উইকেট মেলেনি।

চতুর্থ ইনিংসে দিনের শুরুতে ইমাম উল হক ও আজহার আলীকে ফিরিয়ে দলকে ব্রেকথ্রু এনে দেন লিও। তবে বাবর আজম তখন ক্রিজে। বাবরের উইকেট নেওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চা-বিরতির আগে সেই সুযোগও এলো। নাথান লিঁওকে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন বাবর। কিন্তু ডিপ মিড উইকেট থেকে কিছুটা ধীরে দৌড়ে আসায় ট্রাভিস হেডের আঙুল লেগে ক্যাচ পড়ে যায়!

শেষ সেশনের শুরুটা অবশ্য ভাল করতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় বলে করা ওভারপিচড ডেলিভারি কাভারের উপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকান সাজিদ খান। তবে কামব্যাকও করেন দ্রুতই। স্টিভ স্মিথের হাতে ক্যাচ দিয়ে লিঁওর বলেই আউট হন বাবর আজম! বাবরের উইকেট যেন অস্ট্রেলিয়ার জন্য জয়ের আভাস।

স্বীকৃত আর কোনো ব্যাটারও নেই। কয়েক ওভার বাদেই হাসান আলীকে বোল্ড করে পাঁচ উইকেট নেওয়ার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়াকে তখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান লিঁও। তাঁর উদযাপনই বলে দিচ্ছিল এক ঐতিহাসিক জয়ের দোরগোড়ায় অজিরা।

পুরো দিনই বোলিং করানো, ফিল্ডিং সেট করা সব নিজের গেমপ্ল্যান অনুযায়ী করেছেন কামিন্স। প্রয়োজন ছাড়া বাউন্ডারিতে অতিরিক্ত ফিল্ডার কিংবা ক্যাচিং পজিশনে অতিরিক্ত একজনকে তিনি রাখেননি। একটা সময় এমনও ছিল এই টেস্টও হতে যাচ্ছে নির্বিষ ড্র। কিন্তু নিজের গেমপ্ল্যানই বজায় রেখে এগিয়ে যান কামিন্স। ভাগ্যটাও সহায় ছিল। পরিকল্পনা মতোই মাত দিয়ে দেন পাকিস্তানকে!

এইতো ২৬ দিন আগেই ২৪ বছর পর পাকিস্তানে পা রাখে অজিরা। অজিদের আসায় অন্যান্য দলগুলোও এখন পাকিস্তানে সিরিজ খেলতে আগ্রহী হবে। পাকিস্তানের জন্য এই সিরিজটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাচের পর বেশ কয়েকজন অজি সিনিয়র ক্রিকেটার পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমেও যায়।

ভক্তদের অটোগ্রাফ দিয়ে তাদের সাথে ক্যামেরাবন্দীও হন অনেক ক্রিকেটারই। পাঁচ দিনের ১৫ সেশনের টেস্ট জয় কিংবা স্রেফ এক ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ই নয়, পাকিস্তান জিতেছে মিলিয়ন হৃদয়ও!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link