ব্যাড বয় থেকে জেন্টেলম্যান

ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম টাই ম্যাচ, প্রথম সুপারও ভার! যদিও খেলার শেষ ওভার আর সুপার ওভারের মধ্যে আমি কেন তফাত দেখি নাই, বোলার ও একই ছিল, ব্যাটসম্যান ও একই ছিল!

এক হিসেবে খেলা হয়ে গেল ৫১ ওভারের! আজব নিয়মের খেলা ক্রিকেট। দু’দলের রান সমান, সুপার ওভারের রান ও সমান; কিন্তু বিজয়ী দল ইংল্যান্ড! কেন জানেন? বেশি বাউন্ডারি মারার কারণে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন! নিউজিল্যান্ডের মন খারাপ, এরকম হবে জানলে হয়তো নিউজিল্যান্ড আরো কয়েকটা বাউন্ডারি মেরেই রান করতো!

বেচারা নিউজিল্যান্ড!

সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের হয়ে নামেন ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার দুই নায়ক জস বাটলার আর স্টোকস। বোল্টের ওভারে তোলেন তারা ১৫ রান। জোফরা আর্চারের ওভারে গাপটিল আর নিশামও করেন ১৫ রান। ম্যাচটাকে সর্বকালের সেরা ফাইনাল এ কথা বলা নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না!

ফাইনাল ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচের যে ইনিংস খেললেন ক্রিকেটের ব্যাডবয় বেন স্টোকস; সেটি তার স্বভাবজাত ইনিংস নয়! তাঁকে নিয়ে না লিখলেই নয়।

বলা যায় একেবারে একা একাই খেলাটিকে টাই নামক শব্দে রুপান্তরিত করলেন! নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দেখে শুনে বিশ্বকাপটা হাতে নেয়ার আশায় তুলির আচড়ে নিজস্ব ভাবনায় মনের মত করে এঁকেছেন নিজের ইনিংসটি!

এটাকে গ্রেট না বলে আপনি কি বলবেন! সেই কবে কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখেছিলেন এমন ইনিংস স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বের করতে হবে!

অথচ কিছুদিন আগে ব্রিস্টলে নাইট ক্লাবের সামনে মারপিট করে গ্রেফতার হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সহ-অধিনায়ক বেন স্টোকস। পরে জামিনে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলেও গ্রেফতার হওয়ার কারণে তাঁকে দল থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)।

এর আগেও স্টোকস বিতর্কে জড়িয়েছেন। ২০১২-তেও তিনি নাইট ক্লাবে ঝামেলা করে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০১৩-তে অস্ট্রেলিয়ায় কার্ফু উপেক্ষা করে পানশালায় গিয়েছিলেন বলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে একটি ওয়ান ডে ম্যাচে কোনও রান না পেয়ে আউট হওয়ার পর ড্রেসিং রুমের লকারে ঘুসি মেরে হাত ভাঙেন। যার ফলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি তিনি।

অথচ আইপিএলের কথা ধরুন, বেন স্টোকসকে ১২কোটি ৫০ লাখে কিনে নিয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস। হয়েছিলেন আইপিএলের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। চেন্নাই সুপার কিংস ও কিংস একাদশ পঞ্জাবের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর স্টোকসকে নিতে সমর্থ হয় দু’বছর নির্বাসন কাটিয়ে ফেরা রাজস্থান।

ইডেন গার্ডেন্স, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড আর লর্ডস হল বিশ্ব ক্রিকেটের তিনটি সেরা মাঠ। এই তিনটে মাঠেই এর আগে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে ইংল্যান্ড। ১৯৭৯ লর্ডসে, ১৯৮৭ ইডেনে আর ১৯৯২ সালে এমসিজি-তে। তিনটেতেই হেরেছে।

আবার সেই লর্ডস। না, ১৯৭৯ এবার আর ফিরে আসেনি নতুনভাবে।

একটি জিনিস জানেন, বিশ্বকাপের ফাইনালের এমন সময়ে ছেলে বেন কে অবশ্যই তার বাবা মা সমর্থন দিয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেন স্টোকসের জন্য বিষয়টি হয়েছে উল্টো! ইংলিশ অল-রাউন্ডারের বাবা জেরার্ড স্টোকস চেয়েছেন, ছেলের শিরোপা জয়ের ইচ্ছে যেন পূরণ না হয়!

তাছাড়া এটা কোনো কথার কথা নয় জেরার্ড স্টোকস স্বয়ং নিজের মুখে এই কথা বলেছেন। জেরার্ড আজ নিউজিল্যান্ডের সমর্থক। হ্যাঁ, বিশ্বকাপ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকেই সমর্থন দিয়েছেন স্টোকসের বাবা। কারণ, স্টোকসের বাবা জেরার্ড নিউজিল্যান্ডের নাগরিক।

তবে শেষ ওভারের রান-আউটের থ্রোতে বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে যে চারটি হলো, সেটাতে ভাগ্যদেবী হয়তো এসে বসেছিলেন! সে চার রান না হলে কিন্তু নিউজিল্যান্ড জিতে যেতো মনে হয়! আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনাকে নাকি স্টোকস অনুরোধও করেছিলেন যেন তিনি রান চারটা ফিরিয়ে নেন। কে জানতো, বাস্তবের ব্যাডবয় মাঠে এমন স্বভাববিরুদ্ধ ভদ্রলোক হয়ে যাবেন!

বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথম বোধ হয় খেলা টাই হয়ে সুপার ওভারে গড়ালো। সুপার ওভারের ধারণা খুব একটা পুরাতন নয়! তবে, সে যাই হোক এবারের বিশ্বকাপে ছেলে বেন স্টোকস জিতে গেল, পিতা জেরার্ড স্টোকস হেরে গেল!

পিতা-পুত্র যেই জিতুক বা হারুক, বিশ্বকাপ কিন্তু স্টোকস পরিবারেই গেল! ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনাল, ইংল্যান্ড ট্রফি জিতেছে ঠিকই কিন্তু ম্যাচ জিতেছেন বেন স্টোকস।

বিশ্বকাপ দিয়েই কেবল বেন স্টোকসের জয়যাত্রা থামেনি। বিশ্বকাপের পরই অ্যাশেজের হেডিংলি টেস্টে বিস্ময়কর এক ইনিংস খেলে তিনি ইংল্যান্ডকে জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন। এরপর বাবার অসুস্থতা আর বায়োবাবল জনিত কারণে মানসিক অবসাদে ভুগে ক্রিকেট থেকে দূরে সরেছিলেন, তবে তিনি আবার ফিরেছেন। কারণ, হারিয়ে যদি যেতেই হয় – তাহলে তিনি আর স্টোকস কেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link