যে ভিড় থেকে একদিন মানুষ উঠে আসে, মানুষকে একদিন সেই ভিড়েই ফেরত যেতে হয়। কিন্তু সেই ভিড়কে আপন করে নিতে কয়জন পারে?
‘বুড়িগঙ্গার ওইদিকে বাবু বাজারে একটা ব্রিজ হলে মানুষের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো’, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন মানুষটি। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন বিশ্ব-বিজয়ের পুরষ্কার। তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর শেকড়কে! বুড়িগঙ্গা-পাড়ে অবস্থিত বাবু বাজারের সেই বসতিকেই।
ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বস্তি থেকে পেলে ম্যারাডোনা রোনালদিনহোরা উঠে আসেন। তাদের নিয়ে জয়জয়কার হয়। তাদের জীবনের সংগ্রাম আর একাগ্রতা নিয়ে রূপকথা সৃষ্টি হয়। ক্রিকেট ফুটবলের তুলনায় অনেক ছোট গণ্ডির খেলা। তার মাঝে বাংলাদেশের গণ্ডিটা তখন আরও ছোট ছিল, তা নাহলে আজ হয়ত বস্তি থেকে উঠে আসা বাংলাদেশি একজন বিশ্বসেরার রূপকথাও হাজার বছর ধরে পৃথিবীকে শুনানো হত।
অবশ্য দু:খ কি? বিশ্বে না হোক, বাংলাদেশের জন্য তো এই ব্যক্তি সর্বকালের সেরাদেরই একজন। প্রকৃত মহানায়ক! প্রেক্ষাপট বিচারে হলেও, পেলে ম্যারাডনাদের চাইতে আমাদের মোহাম্মদ রফিকের স্ট্রাগলটা কম কিসের!
বাবা মরা যৌথ পরিবার, বুড়িগঙ্গার তীরের জিঞ্জিরার ঘিঞ্জি বস্তিতে এরকম অসংখ্য শিশু-কিশোর-তরুণের জীবন তো অকালেই ঝরে যায়, এটা খুবই স্বাভাবিক ধরা হয়! কিন্তু রফিক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান। তাঁর ধমনীতে শহীদের রক্ত। তিনি ঠিক করলেন লড়াই করেই বাঁচবেন। বাবা দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন, রফিক করবেন খেলার মাঠে।
হতদরিদ্র পরিবারের শত বাধা, দায়িত্ববোধের বেড়াজাল ভেঙে তাই ফেরিতে করে পালিয়ে আসতেন ঢাকায় ক্রিকেট খেলতে! রোজ রোজ! নদীর ঘাটে তাঁর গরু চরতো, তিনি চড়তেন তার স্বপ্নের সওয়ারী। স্বপ্ন যে দেখতে শেখে তাঁকে তো আর আটকে রাখা যায় না। দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ, ঢাকার ক্রিকেট হয়ে রফিকের স্বপ্ন শেষ হয় জাতীয় দলে এসেই! বাঁ-হাতি পেসার থেকে স্পিনার হয়েছিলেন বহু আগেই!
ক্রিকেটার রফিক থেকে ব্যক্তি রফিককে আলাদা করা আসলেও কঠিন। লড়াই করাটা তাঁর ধমনীতে! বস্তির ওই কঠিন পরিবেশ থেকেই তো লড়াইটা শিখে এসেছিলেন! অত শিক্ষা-দীক্ষা, টেকনিক্যাল মারপ্যাঁচে তাঁর মাথা নেই। তাঁর সাফ কথা, মাঠে ক্রিকেট খেলতে হবে নিজেকে উজাড় করে! ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং – যখন যে দায়িত্ব আসবে সেখানেই ভালো না করতে পারলে তুমি কিসের ক্রিকেটার!
সারাজীবন এই আদর্শের সুষ্ঠু প্রয়োগ মাঠে করে গেছেন রফিক। একেবারে হাতে কলমে! বল হাতে চরম কিপটে, ধারাবাহিক উইকেট টেকার, স্পিন টার্ন আর্ম বলের জাদু। ব্যাট হাতে অর্ডারের যেখানেই নামানো হয় সেখানেই বিস্ফোরক ব্যাটিং! আর গা উজাড় করা ফিল্ডিং! ’৯৪ সালে সেই সার্ক টুর্নামেন্টে ২৫ রানে ৩ উইকেট নিয়ে শুরু, এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রতিটি ম্যাচেই রফিককে ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিং এ নিজেকে উজাড় করে দিতে দেখেননি, এমনটা মানুষ বলতে পারবে না!
হতাশার অন্ধকার দিনগুলিতে মাঠে এক রফিকের উপস্থিতিই কতো আশা জাগাত তা অগ্রজরা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন! ভারতের বিপক্ষে অভিষেকে শচীনের উইকেট, শচীনের ড্রেসিংরুমে সবাইকে সেই সাবধানবাণী, ‘রফিক আর্ম বলটা খুবই ভালো দেয়, সবাই ওকে সোজা ব্যাটে খেলবে!’
এরপর ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে ১৯ উইকেট, ফাইনালে ওপেনিং এ ২৬ রানের ঝড়, কেনিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৮-এ ৭৭ রান আর তিন উইকেটের সেই ক্লিন সুইপ – সবই তো ইতিহাসের অংশ এখন! আমরা অনুজরাও দেখেছি অধারাবাহিকতার দিনগুলিতে রফিকের বোলিংই ছিল আমাদের একমাত্র ধারাবাহিকতা!
রফিকের ব্যাটেই হত বেশিরভাগ লজ্জা ঢাকার চেষ্টা! তাঁর বল দেখেই একমাত্র মনে হত ইন্টারন্যাশনাল কোন স্পিনার বল করছে! তাঁর বল পড়তেই বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা ধাঁধায় পড়তেন। কারণ তিনিও ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেই বল করতেন! ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে মাঝের ওভারগুলোয় বাঁদর-নাচ নাচিয়েছেন তা নিজের চোখে দেখা!
রাহুল দ্রাবিড়ের মত টেকনিক্যালি কারেক্ট ব্যাটসম্যান ফ্লিক করতে গিয়ে বল চোখে দেখলেন না! অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন! ইউটিউবে ম্যাথু হেইডেনকে ২০০৩ সালে করা আরেকটি ডেলিভারি দেখেছিলাম। শর্ট লেংথের বলটা যেভাবে লাফিয়ে উঠে ভিতরের দিকে ঘুরল, বুঝতেই পারেননি হেইডেন! ‘বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনাররা টার্ন করাইতে পারে না’ – এখনকার চরম সত্যটায় রফিক ভক্তরা বোধহয় সবচেয়ে বেশি আফসোস করেন! ‘রফিকীয় টার্ন’ এর কথা ভুলেন নাই যে তারা!
টেস্টে ১০০ ও ওয়ানডে তে ১২৫ উইকেট নিয়েছিলেন। ওয়ানডেটা বলা যায়না, তবে টেস্টে সহজেই দ্বিগুণের বেশিসংখ্যক উইকেট নিতে পারতেন রফিক। কিন্তু টেস্টে তখন আমরা বোলিং করতামই তো এক ইনিংস! চতুর্থ আর পঞ্চম দিন টেস্ট ক্রিকেট হয়ে যায় স্পিনারদের লীলাভুমি। রফিককে আমরা কয়টি টেস্টে চতুর্থ ও পঞ্চম দিন এনে দিতে পেরেছিলাম?
মুকুট অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন! জিঞ্জিরার বস্তি থেকে দেশসেরা ক্রিকেটার তিনি কিভাবে হয়েছিলেন। সেটার চেয়েও বড় রূপকথা হল যখন অর্জন-সম্মান, ধন-সম্পদ তাঁর দুইপায়ে লুটাচ্ছে, তখনও তিনি কি পরিমাণ মাটির মানুষ ছিলেন! তা বোথ – অন ফিল্ড অ্যান্ড অফ দা ফিল্ড! পাকিস্তানের সাথে মুলতানের সেই ট্র্যাজেডিতে রান আউটটা না করে তিনি হয়েছিলেন ক্রিকেটীয় মহানুভবতার প্রতীক, প্রতিটা উইকেট নেওয়ার পর তাঁর সরল হাসি, কোন প্রকার ভালগারিজমে না গিয়ে স্রেফ নিখাঁদ শিশুদের উল্লাস জানাত যে তিনি কতটা পরিষ্কার মনের।
ক্রিকেট মাঠের ক্রিকেটাররা মাঠের বাইরের ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেন কমই! কিন্তু রফিক যেন মাঠের বাইরেও পুরান ঢাকার সেই রফিক! আঞ্চলিক ভাষায় সবার সাথে কথা বলা, হাসিমুখে চলা। যাকে যতটা পারেন দিয়ে সাহায্য করা! সারাজীবন চেয়েছেন তাঁর এলাকার মানুষদের উন্নতি! প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাওয়া সেই ঐতিহাসিক মহানুভব আবদার।
এরপর পুরষ্কারের অর্থ দিয়ে এলাকায় স্কুল করেছিলেন ‘আমরা তো লেখাপড়া করতে পারি নাই, পোলাপাইনগুলা যেন পারে’ বলা এই মহান মানুষটি। ক্রিকেট খেলে পাওয়া জমি দান করে দিয়েছিলেন চক্ষু হাসপাতাল করতে! ভারত থেকে সৌরভ গাঙ্গুলীর প্রস্তাব উপেক্ষা করে দেশে থেকে গেলেন দেশের মানুষ, দেশের ক্রিকেটারদের জন্য কিছু করতে।
কিন্তু সেই রফিককে আমরা কি দিয়েছি? কি দিচ্ছি?
রফিককে উইকেট বঞ্চিত করা ধরলাম না হয় অবহেলা ছিল না, ছিল তখনকার বাস্তবতা। কিন্তু এখন? এখন এই সোনালী ক্রিকেটের দিনে যখন তরুণ ক্রিকেটারদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে রফিকের মত একজন অভিজ্ঞ ও লড়াকু মনোভাবের কোচ প্রয়োজন, বিসিবি কি তাঁকে স্মরণ করছে?
খেলা ছাড়ার ১০ বছর পরেও কি জাতীয় দলের সাথে কাজ করার সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়েছে? ২০১৬ সালে একবার এইচপিতে স্পিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাকা হয়েছিল শুনেছিলাম, সেটা কি এখনও কন্টিনিউ করানো হচ্ছে? না! রফিককে আমাদের ক্রিকেটের হর্তাকর্তারা মনে রাখেনি। তাঁকে আবারো তার বস্তিতেই ফেরত পাঠিয়েছেন।
এবং রফিকও খুশিমনেই ফিরে গেছেন তার শিকড়ে! এখনও আছেন সেই মাটির মানুষই। নিজের এলাকায় নিজের রডের ব্যবসা দেখছেন। এলাকার মানুষদের সাহায্য করছেন। যখন বিপিএল, লিগ-টিগে ডাক পান তখন হাসিমুখেই ছুটে আসেন, ক্রিকেট নিয়ে থাকেন। টক শো গুলোতে প্রাণখুলে নিজের সরল ভঙ্গিতে কথা বলেন। আবার ফিরে যান তাঁর শিকড়ে।
মোহাম্মদ রফিককে নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আজ একটা জিনিস বুঝলাম যে মানুষ আসলে তাঁর কোন জিনিসটার ভক্ত ছিল? বোলিং? ব্যাটিং? নাহ! মানুষ আসলে ভক্ত ছিল তাঁর স্পিরিটের, তাঁর স্পোর্টসম্যানশিপের। তাঁর লড়াকু মনোভাবে আমরা হতাম উদ্দীপ্ত আর তাঁর শিশুসুলভ বিনম্রতায় ও মহানুভবতায় জাগত আমাদের শ্রদ্ধা!
সাধেই কি তিনি বস্তির ছেলে থেকে ঢাকার ক্রিকেটের সুপারস্টার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম গ্লোবাল আইকনদের একজন হয়েছিলেন? সাধেই কি তাঁকে দেখে বাঁহাতি স্পিনার হওয়ার একটা ক্রেজ শুরু হয় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে? সাধেই এনামুল জুনিয়র, সাকিব, রাজ্জাকরা ক্যারিয়ারের শুরুতে তাঁর গাইডেন্স বাধ্য ছাত্রের মত ফলো করতেন! একেবারে ১২০% খাটি ‘ক্রিকেটীয় স্পিরিট’ ছাড়া হয়ত ক্রিকেটার হওয়া যায়, কিন্তু ক্রিকেটের রোল মডেল হওয়া যায় না! জীবনের রোল মডেল হওয়া যায়না!