একটা সময় পর্যন্ত মাঠটার আলাদা কোনো বিশেষত্ব ছিল না। স্রেফ সাধারণ মানুষের উপভোগের, উদযাপনের একটা জায়গা ছিল এই মাঠ। যত দিন গড়িয়েছে তত এটা হয়ে উঠেছে অভিজাত। ঠিক যেন রোমান সাম্রাজ্যের কোন অ্যারেনা। বলছিলাম ফুটবলের এক তীর্থস্থানের গল্প। নাম তার স্ট্যাডিও ডি মারাকানা; বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল-মঞ্চগুলোর একটি। ফুটবলপ্রেমী মাত্রই একবার হলেও ঘুরে আসতে চাইবেন অত্যাধুনিক এই স্টেডিয়ামটিতে।
১৯৫০ সালের ১৬ জুন বিশ্বকাপের আসর দিয়ে যাত্রা শুরুর পর দুবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে স্টেডিয়ামটি। যাত্রা শুরুর ঠিক এক মাসের মাথায় ১৬ জুলাই একটি জাতির স্বপ্নের ইতি ঘটে এই স্টেডিয়ামটিতে। কেননা সেবারের ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে ১-২ গোলে হেরে গিয়েছিল ব্রাজিল। অ্যালসিডেস ঘিগিয়া উরুগুয়ের জন্য তৈরী করেছিলেন এক রূপকথা। রূপকথার নাম ‘মারাকানাজো’। ব্রাজিলিয়ানদের নিজেদের রক্তে-মাংসে তৈরি করা স্টেডিয়ামে উৎসব করে ভিনদেশিরা।
এরপর রেকর্ড পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও সেলেচাওদের এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় সে দু:সহ স্মৃতি। এবারের আসরটির আয়োজক হিসাবে ৬৪ বছরের পুরনো হিসাবটি মেটানোর সুযোগ আবার কবে পাবে, কে জানে।
মারাকানা স্টেডিয়াম প্রতিটি ব্রাজিলিয়ানেরই আবেগের জায়গা। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ তো বটেই, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ঐতিহাসিক অনেক ঘটনারই সাক্ষী এই স্টেডিয়াম। পেলের হিসাবে তার ক্যারিয়ারের হাজারতম গোলটিও এসেছিল এই মাঠেই। ১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর ভাস্কো দ্য গামার বিপক্ষে স্যান্তোস স্ট্রাইকার মাঠভর্তি দর্শকের সামনে এই কীর্তি গড়েন।
আরেক ব্রাজিলীয় কিংবদন্তী গারিঞ্চার খেলাও এই মাঠে দর্শকরা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। গত বছর কনফেডারেশন কাপের ফাইনালে ব্রাজিলের নতুন প্রজন্মের এক দলের হাতে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে বিধ্বস্ত করার ঘটনাটিও ঘটে এখানেই।
ব্রাজিল সরকার ১৯৫০ সালের আসরটির সুবাদে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার পর নতুন একটি স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করে । সাতজন স্থপতির এক দল স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ শুরু করে ১৯৪৮ সালের দুই আগস্ট। প্রায় দশ হাজার শ্রমিকের ৬৬৫ দিনের পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে ওঠে প্রাসাদতুল্য এই স্টেডিয়াম।
স্টেডিয়ামটির নাম মূলত স্ট্যাডিও ডি জার্নালিস্টা মারিও ফিলহো। মারিও রডিগ্রেজ ফিলহো নামের একজন সাংবাদিক স্টেডিয়ামটির নির্মাণ কাজের জন্য বিশেষ প্রচারণা চালান। তার প্রতি সম্মান দেখাতেই কর্তৃপক্ষ স্টেডিয়ামের এমন নামকরণ করেন।
যদিও রিও ডি জেনিরো শহরের উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত মারাকানা নদীর সাথে মিলিয়ে স্থানীয় জনসাধারণ এর আদুরে নাম দিয়েছে মারাকানা স্টেডিয়াম। উদ্বোধনের পর ব্রাজিলিয়ান এক পত্রিকা লিখেছিল, ‘আজ ব্রাজিলের আছে বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। এটা এমন এক অসাধারণ ব্যবস্থা যেখানে গোটা বিশ্ব একসাথে বসে ফুটবলের বিশালত্ব ও শৌর্য উপভোগ করতে পারবে।’
শুরুতে মাঠটির ধারণক্ষমতা ছিল এক লাখ তিরাশি হাজার। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রাক্কালে আড়াই বছর স্টেডিয়ামটি বন্ধ রেখে ৬০ কোটি ডলার ব্যয়ে এর সৌন্দর্য বর্ধনের পর ধারণ ক্ষমতা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৫৩১ জনে। তাতে বিন্দুমাত্রও কমেনি মারাকানার সৌন্দর্য। ‘ফুটবল এক্সপ্লেইনস ব্রাজিল’ বইটির লেখক মার্কোস গাটারম্যান যথার্থই বলেছেন, ‘আপনি যখন ফুটবল নিয়ে ভাববেন তখন অবশ্যই আপনি মারাকানা নিয়ে ভাবতে বাধ্য।’
মারাকানাজোর সেই দু:স্বপ্ন ভাঙার মিশনে ২০১৪ বিশ্বকাপটা শুরু করেছিল ব্রাজিল। স্বপ্ন ছিল এই মারাকানায় বিশ্বকাপের ট্রফি তুলে ধরার। হয়নি, বরং সেমিফাইনালে ৭-১ গোলে জার্মানির কাছে বিধ্বস্ত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায় এই স্বপ্ন।
মারাকানা দু:স্বপ্ন হয়ে আছে লিওনেল মেসিরও। আর্জেন্টাইন হলেও এই মাঠেই তো ফাইনালে অধরা বিশ্বকাপটা চুরি হয়ে যায় সেই জার্মানির কাছেই। মারাকানা তাহলে স্বপ্ন চুরিরই মঞ্চ!