স্কুল ক্রিকেটে ব্যাট হাতে প্রথমবার যখন খেলতে নামলেন বয়স তখন মাত্র ৯! অল্প বয়সেই ক্রিকেটীয় প্রতিভায় নজর কেঁড়েছিলেন অনেকের। আর তখন থেকেই অনেকে তাঁকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ভবিষ্যত ‘কুমার সাঙ্গাকারা’ ভাবতেন। পেশি শক্তি আর আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য অনেকেই ক্রিস গেইলের সাথেও তুলনা করা হত! ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া ক্রিকেটে অধিকাংশই মানেন তাঁর মধ্যে আছে বিশেষ প্রতিভা।
আগ্রাসী, বিধ্বংসী – এই বিশেষণগুলো ক্যারিবিয়ান তারকা শিমরন হেটমায়ারের নামের সাথে বেশ মানাসই। অল্প বয়সেই পরিস্থিতি বুঝে খেলাটা শিখে গিয়েছিলেন। বুলেট গতিতে বলকে বাউন্ডারি পার করতে পারতেন অনায়াসেই। বড় ভাই সিওন হেটমায়ার ও কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান তারকা ব্রায়ান লারাকে মানতেন অনুপ্রেরণা।
২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৬। বড়দিনের একদিন বাদেই বক্সি ডে তে গায়ানায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ওয়ারিয়র্স ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার সময় থেকেই ছিলেন কোচদের বিশেষ নজরে। কোচরাও মনে করতেন বছর কয়েকের মাঝেই বিশ্বক্রিকেটের তারকা হতে যাচ্ছেন এই বাঁ হাতি ব্যাটার।
২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সুযোগ পান তিনি। যদিও নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি মোটেও। পাঁচ ম্যাচে সুযোগ পেয়ে তিন ম্যাচেই ফিরেন ডাক মেরে! হেটমায়ারের জন্য এটি ছিল দুঃস্বপ্নময় এক গল্পের মত।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকটাও ছিল চরম হতাশার। উইকেটের পেছনে একাধিক দৃষ্টিকটু ক্যাচ ছাড়ার পর ব্যাট হাতেও ছিলেন ব্যর্থ। হেটমায়ার যেন শুরুতেই পা হড়কে গেলেন। কিন্তু এরপরই মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দেন হেটমায়ার।
যদিও প্রথম শ্রেণির মত লিস্ট এ ক্রিকেটের অভিষেকটা অবশ্য হতাশাজনক ছিলনা হেটমায়ারের। গায়ানার হয়ে লিস্ট এ অভিষেকেই ত্রিনিদাদ ও তোবাগোর বিপক্ষে গড়েন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। যদিও টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই গোল্ডেন ডাকে ফিরেন হেটমায়ার!
অবশ্য ভাগ্য হেটমায়ারের সাথ ছাড়েনি। কারণ ব্যর্থতার পরেও স্রেফ সামর্থ্য আর সম্ভাবনার কারণে ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও খেলার সুযোগ পান তিনি। তাও কিনা এবার গুরুদায়িত্বে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক! অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে স্কুল ক্রিকেট থেকেই তিনি অভিজ্ঞ। ক্লাস ৪ থেকে ১০ পর্যন্ত স্কুল ক্রিকেটে তিনি অধিনায়কত্ব করেন। এরপর গায়ানা অনূর্ধ্ব-১৫ এবং ১৭ দলের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন হেটমায়ার।
২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ৬ ম্যাচে করলেন ১৫৮ রান, কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দেখা পেলেন টানা ফিফটির। সেবার হেটমায়ারের নেতৃত্বে যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
হেটমায়ার বনে গেলেন চ্যাম্পিয়ন!
টি-টোয়েন্টির যুগে বেশিরভাগ ক্রিকেটারই যেখানে এই ফরম্যাট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন সেখানে আগ্রাসী হেটমায়ারের অভিষেকটা অদ্ভুতভাবে হয়েছিল টেস্টে! ২০১৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট দলে ডাক পান তিনি। অভিষেক সিরিজে ব্যাট হাতে ছিলেন চরম ব্যর্থ। যদিও নির্বাচকরা আস্থা রেখেছিলেন এই তরুণের উপর।
পরের সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দেখা পান মেইডেন ফিফটির। ওই সিরিজেই ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় হেটমায়ারের। নিজের তৃতীয় ম্যাচে আরব আমিরাতের বিপক্ষে দেখা পান মেইডেন সেঞ্চুরির। একই বছর ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে খেলেন ৯৩ বলে ১২৫ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। পরের সিরিজে ভারতের বিপক্ষে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও আরেক ম্যাচে করেন ৯৪ রান।
হেটমায়ার যেন ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছিলেন। টি-টোয়েন্টি অভিষেক হলেও নিজের পছন্দের ফরম্যাটে নিজেকে ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারেননি তিনি। তবে ততদিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরবর্তীতে তারকার তকমাটা গায়ে জড়িয়ে ফেলেছেন হেটমায়ার।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক হন তিনি। ৮২ বলে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করেন হেটমায়ার। সেবার বিশ্বকাপেও খেলার সুযোগ পান তিনি। আর আইসিসির সেরা পাঁচ তরুণ প্রতিভাবানের তালিকায় ঠাঁই পান এই ক্যারিবিয়ান তারকা।
২০১৮ সালে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) ২২ বছর বয়সে জামাইকা তালাওয়াইসের বিপক্ষে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন হেটমায়ার। ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে চতুর্থ দ্রুততম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন এই ক্যারিবিয়ান তারকা। মাত্র ২৯ ইনিংসেই ওয়ানডেতে ১ হাজার রান পূর্ণ করেন হেটমায়ার।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) এখন নিয়মিত মুখ তিনি। গেল তিন আসর ধরেই চড়ামূল্যে পেয়েছেন হেটমায়ার। যদিও ব্যাট হাতে সেখানেও অধারাবাহিক তিনি।
ক্রিকেটার না হলে তিনি ফুটবলকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। ফুটবলের প্রতি ঝোঁকটাও ছেলেবেলা থেকেই। ফুটবলটাও দারুন খেলেন। এছাড়া কথায় বেশ পটু তিনি। প্রচুর গল্প করতে আর আড্ডা দিতে ভালবাসেন হেটমায়ার। এছাড়া সতীর্থদের মতে বেশ মজার মানুষও তিনি! যদিও চেহারায় সেই ছাপটা একেবারেই নেই। ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালানোর জন্য বেশ নামডাক হেটমায়ারের। যদিও কেন যেন ধারাবাহিক পারফরম করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন।
যে সামর্থ্য আর প্রতিভা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছেন তার অনেকটুক এখনও ব্যবহার করতে পারেননি এই ক্যারিবিয়ান তারকা। বয়সটা মাত্র ২৫! এখনও পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। ইতিমধ্যেই রঙিন পোশাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার বনে গেছেন তিনি। আপাতত ধারাবাহিকতায় ফেরাটাই লক্ষ্য। কোচদের করা ভবিষ্যত বানী হয়তো বাস্তবে রূপ দিয়ে ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে সেরাদের কাতারে নিয়ে যাবেন হেটমায়ার!
আপাতত, অপেক্ষার প্রহর গণনা করা যাক!