ক্রীড়াপ্রেমী বাইডেন: দ্য আনটোল্ড স্টোরি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হয়ে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে লড়ছেন জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র, যিনি সর্বজনস্বীকৃত জো বাইডেন নামে। ৫৯ তম প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে তার বিজয় এক প্রকার নিশ্চিতই মনে করছেন অনেকে।

অথচ মজার ব্যাপার কী জানেন, ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বারাক ওবামার আমলে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা বাইডেনের রাজনীতিতে আসাই একসময় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কথার মাঝে তোতলাতেন তিনি। একটি শব্দের প্রতিটি সিলেবলের মাঝখানে বিরতি নিতেন, যেমনটি নিতে হয় দুইটি শব্দের মাঝে ড্যাশ থাকলে। তাই তো স্কুলজীবনে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ড্যাশ’!

তবে এরচেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ছোটবেলা থেকেই বাইডেন ছিলেন একজন তুখোড় ক্রীড়াবিদ। তার দৌড়ের গতি ছিল সতীর্থ অন্য প্রায় সকলের চেয়ে বেশি। বাইডেন নিজেই স্বীকার করেন, কথা বলতে ও অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে তার যে দুর্বলতা ছিল, এজন্য প্রায়ই আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতেন তিনি। কিন্তু তাকে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করত তার খেলোয়াড়ি নৈপুণ্য। খেলার মাঠে নিজেকে প্রমাণের মাধ্যমেই সব ব্যাঙ্গকারীর মুখ বন্ধ করে দিতেন তিনি।

বাইডেন ছিলেন ক্লেমন্ট, ডেলাওয়্যারের আর্চমিয়ার অ্যাকাডেমি নামের একটি বেসরকারি স্কুলের ছাত্র। সেখানের ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর উইলমিংটনের প্রধান সংবাদপত্র দ্য নিউজ জার্নাল ওই মৌসুমে আর্চমিয়ার ফুটবল দলের পারফরম্যান্স নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাইডেন সম্পর্কে লেখা হয়, ‘[বাইডেন] দলের সেরা পাস রিসিভারদের একজন।’

ওই সময়ে আর্চমিয়ার ফুটবল দলের কোচ ছিলেন ই. জন ওয়ালশ। ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে তিনিও একই ধরনের প্রশংসা করেন বাইডেনের ব্যাপারে।

১৯৬০ সালেই ওয়ালশ দায়িত্ব নেন আর্চমিয়ার ফুটবল দলের। তখন তিনি এ কাজে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন, কেননা মাত্র বছর দুয়েক আগেই তিনি কলেজ থেকে বের হয়েছেন। তিনি যখন দলের দায়িত্ব নিলেন, তার আগের মৌসুমেই আর্চমিয়ার ছয় ম্যাচে হারের বিপরীতে স্রেফ একটি ম্যাচ জিতেছিল। এমনকি ১৯৪৮ সালের পর থেকে আর কোনো মৌসুমেই দুইটির বেশি ম্যাচ জেতেনি তারা।

এরকম পরিস্থিতিতে স্বভাবতই আর্চমিয়ার দলের ওপর প্রত্যাশার পরিমাণ ছিল খুবই কম। আর তাই আগ্রহী খেলোয়াড়ের পরিমাণও ছিল অতি নগণ্য। প্রাক-মৌসুমে যখন দলে খেলতে আগ্রহী যথেষ্ট সংখ্যক খেলোয়াড় পাওয়া গেল না, তখন ৩০ জনের মধ্যে ১২ জন এমন খেলোয়াড়কে নিতে হলো, যাদের প্রায় কোনো অভিজ্ঞতাই নেই মাঠে নেমে ফুটবল খেলার ব্যাপারে।

এরকম একটি ভগ্নপ্রায় দলেই খেলেন বাইডেন, লেফট হাফব্যাক হিসেবে। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ওই মৌসুমে আর্চমিয়ার চমকে দেয় সবাইকে। আট ম্যাচের সবগুলোতেই জেতে তারা, ফলে কনফারেন্স শিরোপা ওঠে তাদেরই হাতে।

এরকম রূপকথার মতো একটি সাফল্যে মোড়ানো মৌসুম পার করার পেছনে বাইডেন ছিলেন অন্যতম কারিগর। কনফারেন্স টুর্নামেন্টে মোট ২৪ পয়েন্ট নিয়ে তিনি হন প্রতিযোগিতার পঞ্চম সর্বোচ্চ স্কোরার। এছাড়া নন-কনফারেন্স ম্যাচগুলোকেও গোনা হলে ওই মৌসুমে বাইডেনের পয়েন্ট ছিল ৬০ এর অধিক, যা গোটা ডেলাওয়্যার অঙ্গরাজ্যেরই অন্যতম সর্বোচ্চ।

২০১২ সালের মে মাসে ওয়ালশকে ইন্ডাক্ট করা হয় ডেলাওয়্যার স্পোর্টস হল অফ ফেমে, এবং সেদিন তাকে সম্মান জানাতে উপস্থিত ছিলেন তার দলের সাবেক লেফট হাফব্যাক বাইডেন, যিনি ওই মুহূর্তে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টের ভূমিকাও পালন করছিলেন!

এদিকে দ্য নিউজ জার্নাল থেকে জানা যাচ্ছে, বাইডেন কিন্তু শুধু ফুটবলই না, আর্চমিয়ার বেসবল দলেরও একজন সদস্য ছিলেন। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বাইডেন আউটফিল্ডে খেলতেন, এবং ব্যাট করতেনও লাইনআপের শেষার্ধে। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য, ফুটবলে বাইডেন যতটা সফল ছিলেন, বেসবলে অতটা ছিলেন না।

কিন্তু এই যে নিজের ক্রীড়া দক্ষতা ও লড়াকু মানসিকতা, এটিই পরবর্তীতে নিজের রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক সাহায্য করেছে বাইডেনকে। আবার নিজের ফেলে আসা ক্রীড়া জীবনকে কেন্দ্র করে বাইডেনকে রাজনৈতিকভাবে অপদস্থও হতে হয়েছে একবার।

২০১২ সালে কয়েকটি ডানপন্থী গণমাধ্যম ফুটবল খেলার সূত্র ধরে আক্রমণ করে বসে বাইডেনকে। নিজের এক বক্তব্যে ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার ও ইউনিভার্সিটি অফ ওহায়োর একটি ম্যাচের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে নাকি তিনিও খেলেছিলেন। কিন্তু ইয়ারবুক ঘেঁটে দেখা যায়, তালিকায় খেলোয়াড় হিসেবে বাইডেনের নাম নেই। পরবর্তীতে এই বিষয়টি নিয়ে বেশ ভালোই জলঘোলা হয়, এবং ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার নিশ্চিত করে, আসলে বাইডেন ওই নির্দিষ্ট ম্যাচটিতে খেলেননি।

তবে যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে বাইডেনের ফুটবল ক্যারিয়ার খুব একটা সুখকর ছিল না। ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত ফ্রেশম্যানরা ভার্সিটি ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পেত না। তাদেরকে খেলতে হতো ফ্রেশম্যান দলে। বাইডেনও সেই দলেই নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন তার পড়াশোনা একেবারেই হচ্ছে না, এবং জিপিএর অবস্থাও খুবই করুণ (১.৯), তখন তিনি বাবা-মাকে দেয়া কথা রাখতে মনোনিবেশ করেন সিলেবাসের পড়ায়।

অবশ্য এরপরও বাইডেনের মনে সুপ্ত বাসনা রয়েই যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দলে জায়গা পাওয়ার। পরের দুই বছর তিনি সরাসরি খেলেননি বটে, কিন্তু কোচদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন ঠিকই। এক পর্যায়ে সেই লক্ষ্যে তিনি সফলও হন, এবং খুব কাছাকাছি চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় দলে ডিফেন্সিভ ব্যাক হিসেবে নিয়মিত জায়গা পাওয়ার।

কিন্তু ঠিক তখনই বাইডেনের জীবনে আসে এক নতুন মোড়। বসন্তে ফ্লোরিডায় বেড়াতে গিয়ে তার দেখা হয় নিলিয়া হান্টারের সাথে, এবং সাথে সাথেই তিনি প্রেমে পড়ে যান। তবে সমস্যা হলো, নিলিয়া থাকতেন নিউ ইয়র্কের সিরাকিউজ শহরে। তাই বাইডেন ভেবে দেখলেন, তাকে যেকোনো একটি জিনিস বেছে নিতে হবে – সপ্তাহান্তে ফুটবল খেলা, অথবা নিলিয়ার সাথে সময় কাটানো।

শেষমেষ প্রেমেরই জয় হয়। বাইডেন আর নিলিয়ার এই প্রেম এক সময়ে আনুষ্ঠানিক রূপও লাভ করে। নিলিয়াই হন বাইডেনের প্রথম স্ত্রী।

সেই যে ফুটবল খেলা ছাড়লেন প্রেমের টানে, এরপর আর নিজের সেই শেকড়ে ফেরা হয়নি বাইডেনের পক্ষে। প্রথমে তিনি ল’ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু খুব বেশিদিন আইন পেশায়ও থাকেন না। ল’ স্কুল থেকে পাশ করে বেরোনোর পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে নির্বাচিত হয়ে যান। সেখান থেকেই শুরু হয় রাজনীতিতে তার তরতর করে এগোনো।

তবে একটু তলিয়ে দেখলে একটি বিষয় কিন্তু খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারবেন। কথা বলার ক্ষেত্রে নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব ঢাকতেই বাইডেন খেলার মাঠে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে শুরু করেছিলেন। আর একসময় সেই লক্ষ্যে তিনি এতটাই সফল হন যে, কোনো প্রতিবন্ধকতাই আর তাকে দমাতে পারেনি, এবং এখন তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে।

এমন অসাধারণ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্ভাব্য বিশ্বনেতার উত্থানের পেছনে খেলাধুলার যে অসীম অবদান, তা কি অস্বীকার করার উপায় আছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link