অসময়ে দেখা স্বপ্ন ও পথ দেখানো জেসি

তিনি যেই সময়টায় মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেতেন তখন আসলে বাংলাদেশে নারীদের ক্রিকেটটাই আনুষ্ঠানিক হয় নি। ফলে তাঁর সামনে কোন রোল মডেল ছিল না। তাই শচীন টেন্ডুলকারকেই বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের রোল মডেল। এরপর সাথিরা জাকির জেসি মেয়েদের ক্রিকেটের টেন্ডুলকার হয়তো হতে পারেননি তবে এখনকার নারী ক্রিকেটাররা যে পথটায় হাঁটছে সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন জেসিই।

বাবা-মা চাইতেন মেয়ে ক্যাডেট কলেজে পড়বে। মেয়েও পড়াশোনায় বেশ ছিল। ফলে চাওয়া পাওয়ার হিসেব না মেলার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু হঠাত বাধ বাধলো শচীন টেন্ডুলকার নামক এক ভদ্রলোক। ছোট খাটো গড়নের ওই লোকটা ব্যাট হাতে যাই করে তাই মুগ্ধ হয়ে দেখে মেয়ে। নিজের ঘরে বড় একটা পোস্টারও টানিয়ে রেখেছে শচীন টেন্ডুলকারের। লালমনিরহাটে জন্ম নেওয়া এই মেয়েও নাকি ক্রিকেট খেলতে চায়।

প্রথমে হয়তো বাবা-মা একটু হক চকিয়েই গিয়েছিলেন। কেননা তখন বাংলাদেশের ছেলেদের ক্রিকেটই সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে কেউ কল্পানাও করেনি যে মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে। তবে সেই সময় জেসি স্বপ্নটা দেখেছিলেন, সাথে তাঁর পরিবারও বিশ্বাস রেখেছিল মেয়ের উপর।

তবে ক্রিকেট খেলতে চাইলেই তো হবেনা, ক্রিকেট খেলার তো একটা জায়গা প্রয়োজন। জেসি তাই বিকেএসপিতে ভর্তি হবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু তখন তো বিকেএসপিতেও মেয়েদের ক্রিকেট দল নেই। ফলে শ্যুটিংয়েই ভর্তি হতো হলো জেসিকে। আর সুযোগ পেলেই চলে যেতেন ছেলেদের ক্রিকেট খেলার মাঠে।

একদিন স্যারকে সাহস করে বলেই ফেললেন তিনিও ক্রিকেট খেলতে চান। তবে স্যার এক কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন। বিকেএসপিতে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ক্লাসে প্রথম হতে পারলেই ক্রিকেট শেখার সুযোগ পাবেন জেসি। জেসিও প্রথম হয়ে দেখালেন। এরপরই আসলে আনুষ্ঠানিক ভাবে জেসির ক্রিকেট যাত্রাটা শুরু। ছেলেদের সাথে সপ্তাহে দুদিন করে ক্রিকেট শিখতেন।

এরপর আস্তে আস্তে ক্রিকেটে জেসির সতীর্থ বাড়তে থাকলো। একসময় বিকেএসপিতে মেয়েদের ক্রিকেট দল করা হলো। এরপর ২০০৭ সালে ঢাকায় শুরু হলো মেয়েদের ক্রিকেটের হান্টিং। একটু একটু করে এগোতে এগোতে  খেলেছেন জাতীয় দলের হয়েও। তবে এরপর জেসি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন আরো অনেক দূরে।

ক্রিকেট মাঠের বাইরে গিয়েও উপস্থাপনা করেছেন, ক্রিকেট বিশ্লেষণ করেছেন, ধারাভাষ্য দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি আবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন আম্পায়ারিং করে। স্কুল ক্রিকেট প্রথমবারের মত কোন নারী আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করলো। দেশের ক্রিকেটে এই শুরুটাও করে দিয়ে গেলেন জেসিই।

এছাড়া মা হবার পরেও তাঁর ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়াটাও ছিল এক নতুন বার্তা। কেননা বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড থেকে সেভাবে যত্ন নেয়া হয়নি। তবুও নিজেই আবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। ফিটনেস ফিরিয়ে এনেছেন। অনেকেই বলেছে মা হবার পরে ক্যারিয়ার শেষ, তবে জেসি সেসবকে ভুল প্রমাণ করেছেন।

সবমিলিয়ে বাংলাদেশে নারীদের ক্রিকেটের অনেক কিছুর শুরু তাঁর হাত ধরে। বিকেএসপিতে তাঁর জন্যই প্রথমবারের মত মেয়েদের একটি ক্রিকেট দল তৈরি করা দিয়ে শুরু। এরপর অবশ্য গত এক দশকে মেয়েদের ক্রিকেট অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এই পুরো সময়টায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাথিরা জাকির জেসি। এছাড়া কমেন্ট্রি বক্সেও ধারাভাষ্য দিয়েছেন ব্রেট লি, ব্রায়ান লারাদের মত কিংবদন্তিদের পাশে বসে।

এছাড়াও উপস্থাপনা, ক্রিকেট কোচিং, আম্পায়ারিং সহ নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন। তবুও জেসির আসল পরিচয় তিনি একজন ক্রিকেটার। মনটা তাই পড়ে থাকে মাঠে, যখন খেলা থাকে তখন আর কোন কিছুতেই মনোযোগ যায় না। এমনকি মা হবার পরেও ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে গিয়েছেন, পারফর্ম করেছেন। মেয়েদের ক্রিকেট আজ এতদূর আসার পিছনে তাই জেসিদের অবদানই সব থেকে বেশি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link