ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দলটি মৌসুমের শুরু থেকেই ছিল দাপুটে। আর সেই দাপট শেষ অবধি ধরে রাখার ফলও পাওয়া গেল হাতেনাতেই। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ২০২১-২২ মৌসুমের লা লিগা শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছে ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে শেষ হল লা লিগার আরেকটি মৌসুম।
গত মৌসুমের কোচ জিনেদিন জিদানের বিদায়ের পর ডাগআউটে ফিরেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। আর নতুন এই কোচের নেতৃত্বে স্পেনের ঘরোয়া লিগ, লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
নিজেদের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স আর প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কিছুটা ছন্নছাড়া ফর্মের কারনে লিগের তিন ভাগের দুইভাগ ম্যাচ শেষ হতেই শিরোপার দৌড়ে রিয়াল মাদ্রিদের জয় প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
বাকি ছিল শিরোপা নিশ্চিত করার আনুষ্ঠানিকতা। লিগের ৩৪তম সপ্তাহে ঘরের মাঠে এস্পানিওলের বিপক্ষে খেলতে নেমে সেটি পুরণ করে রিয়াল মাদ্রিদ।
সব মিলিয়ে মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৩৪টি ম্যাচ খেলে রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছে ২৫টি ম্যাচে, ড্র করছে ৬টি ম্যাচ এবং বাকি তিনটি ম্যাচে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছে দলটি। এসময় রিয়ালের অর্জন ৮১ পয়েন্ট।
এছাড়া বর্তমান পয়েন্ট টেবিলে চ্যাম্পিয়ন রিয়ালের পিছনে থাকা দুইটি দল সেভিয়া এবং বার্সেলোনা। রিয়াল মাদ্রিদের সমান ৩৪টি ম্যাচ খেলে সেভিয়া জিতেছে ১৭ টি ম্যাচ, ড্র করেছে ১৩ টিতে আর বাকি ৪ টি ম্যাচে কোন পয়েন্ট পায়নি দলটি। এখন পর্যন্ত টেবিল টপার রিয়ালের সাথে দলটির পার্থক্য ঠিক ১৭ পয়েন্টের।
অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী এফ.সি বার্সেলোনার এবারের মৌসুম একেবারেই ভাল কাটেনি। বিশেষ করে মৌসুমের শুরুতে দলটি ছিল লিগ টেবিলের প্রায় মাঝামাঝিতে। পরে অবশ্য ক্লাব কিংবদন্তি জাভি হার্নান্দেজ কোচ হয়ে ফেরার পর কিছুটা উন্নতি ঘটেছে দলটির।
এখন পর্যন্ত কাতালান ক্লাবটি সেভিয়ার চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ১৮ ম্যাচে জয়ের বিপরীতে হেরেছে ৬টি ম্যাচ, তাছাড়া পয়েন্ট ভাগাভাগি করেছে ৯টি ম্যাচে। এক ম্যাচ কম খেলা বার্সার সাথে সেভিয়ার পয়েন্ট পার্থক্য মাত্র ১, তাদের তাই সুযোগ আছে লিগে অন্তত রানার আপ হওয়ার।
লিগের অন্যদলগুলোর সাথে পয়েন্টের বিশাল পার্থক্য তাই তো এখনো নিজেদের ৪ ম্যাচ বাকি থাকতেই শিরোপা উদযাপন সেরে নিয়েছে অল হোয়াইটরা।
এই নিয়ে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের এটি ৩৫ তম লিগ শিরোপা। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯-২০ মৌসুমে লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দলটি। সেবার অবশ্য বার্সেলোনার বিপক্ষে লড়াইটা হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি, এবার তেমন কিছুই নয়। রিয়াল মাদ্রিদ রীতিমতো হেসেখেলেই জিতেছে স্প্যানিশ লিগের সিংহাসন।
২০১৮ সালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাসে পাড়ি দেয়ার পরে রিয়াল মাদ্রিদ এখনো তেমন কোনো বৈশ্বিক তারকা’কে দলে ভেড়ায়নি। তাই হয়তো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ২০১৮ সালের পর থেকে বড় কোন সাফল্য নেই লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। তবে দুর্দান্ত টিম ওয়ার্কের কারনে রোনালদো পরবর্তী সময়ে দুই দুইটি লিগ শিরোপা জিতে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ।
বিশেষ করে রোনালদোর অবর্তমানে করিম বেনজেমা দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, নিজেকে গড়ে তুলেছেন সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে।
এবারের মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের লিগ জেতার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নি:সন্দেহে এই ফ্রান্স সুপারস্টারের। এখন পর্যন্ত লা লিগায় সর্বোচ্চ ২৬টি গোল করেছেন তিনি, এছাড়া ১১টি অ্যাসিস্ট করে অ্যাসিস্টের তালিকায় আছেন যৌথভাবে প্রথমে।
বেনজেমা ছাড়াও দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটিয়েছেন ব্রাজিলের তরুণ উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়র। বেনজেমা’র সাথে জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে বারবার আক্রমন করেছেন। ভিনি জুনিয়র এখন পর্যন্ত লিগে ১৪ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো ৯টি গোল।
তবে এমন শিরোপা জয় এক-দুইজনের অবদানে সম্ভব হয়নি। গোলরক্ষক থিবো কোর্তায়া, মিডফিল্ড কিংবা ডিফেন্ডারদের সবারই অবদান রয়েছে রিয়ালের এই অর্জনে।
ট্রফির বিচারে এমনিতেই লা লিগার সেরা দল রিয়াল মাদ্রিদ। শিরোপা সংখ্যায় দুই নম্বরে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা যেখানে জিতেছে মাত্র ২৬টি লিগ শিরোপা সেখানে রিয়ালের ক্যাবিনেটে ৩৫টি লা লিগা শিরোপা রয়েছে।
এছাড়া চ্যাম্পিয়ন হওয়াতে দুইটি বিশেষ কীর্তি গড়েছে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের দুই সদস্য। একজন মাঠের খেলোয়াড়, মার্সেলো ভিয়েরা। অনেকদিন ধরেই রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্স সামলানোর দায়িত্বে থাকা মার্সেলো দলটির হয়ে জিতেছিলেন ২৩টি শিরোপা।
এতে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ শিরোপা উদযাপনের তালিকায় তিনি কিংবদন্তি পাকো হেনতো’র সাথে যৌথভাবে প্রথমে ছিলেন।
আর এখন এ মৌসুমে লা লিগা শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে ২৪তম শিরোপা নিজের করেছেন মার্সেলো। পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ট্রফি উদযাপন করা খেলোয়াড় হওয়ার রেকর্ড করেছেন এই কিংবদন্তি লেফটব্যাক।
এছাড়া বিশেষ কীর্তি অর্জন করা আরেকজন রিয়াল মাদ্রিদের ডাগআউট সামলানোর দায়িত্বে থাকা কার্লো আনচেলত্তি। নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে ইউরোপের সেরা পাঁচটি লিগের চারটিই জিতেছিলেন এর আগে। আর এবার এই ট্যাকটিশিয়ান জিতেছেন আরাধ্য লা লিগা শিরোপা।
আর তাতেই বিশ্বের প্রথম কোচ হিসেবে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের সবকয়টি জেতার দুর্লভ একটি মাইলফলক ছুঁয়ে দেখতে পেরেছেন ইতালিয়ান কার্লো আনচেলত্তি।
অবশ্য ঘরোয়া লিগের শিরোপা জিতে নিলেও রিয়াল মাদ্রিদের এ মৌসুমের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। মর্যাদার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এখনো লড়াইটা বাকি তাদের। এই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ম্যানচেস্টার সিটি’র বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলতে নামবে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা।
দেখার বিষয়, সিটিজেনদের বাধা টপকে লিগ শিরোপার পাশাপাশি ইউরোপ সেরার মুকুটটি জিততে পারে কিনা অল হোয়াইটরা।