খামখেয়ালি রাজার সারল্য

রিচি বেনোর বিখ্যাত সেই ধারাভাষ্য – ‘স্ট্রেইট টু দ্য গ্রাউন্ড! লফটেড ওয়ান অ্যান্ড ইটস আ হিউজ সিক্স। হুপার রিচেস হিজ হানড্রেড অ্যাগেইন্সট শেন ওয়ার্ন!

১৯৯৭ সালে ব্রিসবেনে কার্লটন এন্ড ইউনাইটেড সিরিজে অজি-উইন্ডিজের ম্যাচের কথা। ৪৫ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ব্রায়ান লারাকে সাথে নিয়ে ১৪৪ রানের জুটি, মার্ক টেলর, ওয়াহ ব্রাদার্স আর ওয়ার্নের অস্ট্রেলিয়ার ২৮১ রানের টার্গেটকে ৭ বল বাকী থাকতেই পেরিয়ে যাওয়া, সেদিন হুপারকে কেউই আউট করতে পারেননি!

খোদ ওয়ার্ন নিজে কার্ল হুপারকে মারাত্মক সমীহ করতেন। ২০০৮ সালে তাঁকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলতে পারে এমন সামর্থ্য রাখা ১০০ ব্যাটস্যানের নাম নেন ওয়ার্ন। সেখানে ছিলেন কার্ল হুপার।

‘যেদিন হুপার খেলেন, সেদিন বাকীরা দেখেন!’ – কথাটা বলেছিলেন পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম। কিংবদন্তিতুল্য এই ফাস্ট বোলারকে একবার এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছি, কাদের বিরুদ্ধে বোলিং করতে গেলে উনি অপ্রস্তুত বোধ করতেন, সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম ছিল হুপারের।

ব্যাকফুটে ভাল দখল থাকা ব্যাটসম্যানদের মাঝে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের আমলে, তখন খেলতেন গর্ডন গ্রিনিজ, ম্যালকম মার্শাল, ডেসমন্ড হেইন্স আর কোর্টনি ওয়ালশরা। আর যখন ক্যারিয়ারের শেষ করেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সুর্যটা প্রায় ডুবেই গিয়েছিলো, আলোর বাতিটা শুধু লারার হাতে!

১৯৯৯ তেই অবসর নিয়ে নিয়েছিলেন আবেগী হয়ে, অসুস্থ সন্তান ও পরিবারের পাশে থাকবেন বলে। পরে ফিরেও এসেছিলেন বছর দুয়েক বাদে, আবার এসেই তিনি পেয়ে যা অধিনায়কত্ব। দলের দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে, যদিও দলের ফলাফল ছিলো বাকী সদস্যদের মতই তথৈবচ!

ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় যে কিনা ৫০০০ রানের সাথে ১০০ উইকেটের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন, সাথে যোগ করুন ১০০ টি ক্যাচ ও ১০০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ – এবং সেটা টেস্ট ও ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটেই! অদ্ভুতভাবে ওয়ানডেতে তার মোট রান ৫,৭৬১ আর টেস্টে ৫,৭৬২ – মানে ওয়ানডের থেকে ১ রান বেশি টেস্টে!

সব মিলিয়ে পুরো ক্যারিয়ারে (লিস্ট এ, প্রথম শ্রেণিসহ) রান করেছিলেন ৪৮,০১৪! সাথে যোগ করুন ১২৬৬ উইকেট, একজন অলরাউন্ডার হতে এর বেশি কিছু মনে হয় লাগেনা।

সব ফরম্যাটে ১০৪ টা সেঞ্চুরি আর ২৪৫ টা হাফ সেঞ্চুরি করেছেন এই গায়ানিজ! ওদিকে মাত্র ৪২৮ বলের জন্য সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১০০০০ বল করা হয়ে উঠেনি আর! হুপার তার ক্যারিয়ারে যেবার প্রথমবার লেগ স্পিন জাদুকর ওয়ার্নের মুখোমুখি হন সেবারের ফলাফল ছিল – প্রথম তিন বলে তিন বাউন্ডারি! বিস্ময়করভাবে কার্ল ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে খেলা ১১৩৫ টা ম্যাচের মাঝে নট আউটই ছিলেন ১৯৩ বার!

ক্যারিয়ারজুড়ে সব ফরম্যাট মিলিয়ে এই ভদ্রলোক ক্যাচই নিয়েছেন শুধু ৮৫৮ টি, ওয়ালশ-অ্যমব্রোসের ভয়ানক বোলিং যুগে স্লিপে বারবার ক্যাচ নেয়া মানুষটিই এই কার্ল হুপার! ইতিহাসের সেরা স্লিপ ফিল্ডার বললে মোটেও অত্যুক্তি করা হবেনা যাকে।

পুরো ক্যারিয়ারে খেলেছিলেন ইংলিশ কাউন্টি টিম কেন্ট ও ল্যাঙ্কশায়ারের হয়ে, আর করেছিলেন আরেক বিরল এবং ‘আনব্রেকিং’ রেকর্ড – কাউন্টিতে খেলা ১৮ দলের সবগুলোর বিরুদ্ধেই সেঞ্চুরি!

বলা হয়ে থাকে, নিজের প্রতিভার অর্ধেকও কাজে না লাগানো ক্রিকেটারদের তালিকা করলে সেখানে হুপারের নাম অবশ্যই থাকবে। কেউ কেউ বলেন, এই তালিকায় প্রথম নামটাই সাবেক এই ক্যারিবিয়ান অধিনায়কের হওয়া উচিৎ। ক্যারিয়ারের বেশীরভাগ ইনিংসেই ভালো শুরু করেও আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন, বারবার নষ্ট করেছেন সম্ভাবনাময় অনেকগুলো ইনিংস, বঞ্চিত করেছেন ক্লাসিক ঘরানার ক্রিকেট দর্শকদের।

তবে সবকিছুর শেষে সবাই কার্ল হুপারকে মনে রাখে এতসব রেকর্ডের জন্য না, ক্রিকেট মাঠের একজন নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে মনে রাখে সবাই। ওয়াসিম আকরাম এজন্যই বলেছিলেন, ‘মাঠের বাইরে ও ছিল নিপাঁট ভদ্রলোক। সব সব নম্র থাকতেন, মাথা রাখতেন ঠাণ্ডা।’

টেস্ট ও ওয়ানডেতে বিরল এক ট্রেবলের মালিক তিনি। তিনিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি ক্রিকেটের প্রধান দুই ফরম্যাটে ১০০ উইকেট, পাঁচ হাজার রান ও ১০০ টি ক্যাচের মাইলফলকে পৌঁছেছেন। আর এখন পর্যন্ত এই ক্লাবে কেবল দ্বিতীয় সদস্য যোগ দিয়েছেন। তিনি হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস।

এই প্রজন্মের কেউই চেনেনা তাঁকে তেমন, তার প্রজন্মের সবাইও মনে রাখার হয়তো প্রয়োজন মনে করেনা, কিন্তু ক্রিকেটের পাতায় একজন হুপারের নাম সবসময়ই বড় অক্ষরে লেখা থাকবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link