খরার বৃষ্টি কিংবা শুধুই মরীচিকা

৪০,১৫০,৪২৮ এই বিশাল অংক একজনে স্রেফ একটা সপ্তাহের বেতন। বাংলাদেশের টাকার হিসেবে প্রায় চার কোটি টাকা পাবেন আর্লিং হাল্যান্ড প্রতি সপ্তাহ শেষে। সপ্তাহে যদি দু’খানা করে ম্যাচ তিনি খেলেন তবে ম্যাচ প্রতি তিনি বেতন পাচ্ছেন দুই কোটির একটু বেশি। একবার ভাবুন! এরপর ভাবতে থাকুন!

এ কথা তো পুরোনো। আর্লিং হ্যালান্ড আগামী মৌসুমে যুক্ত হতে যাচ্ছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম ধনী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে। প্রাথমিক আলাপ আলোচনা শেষ। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও নাকি প্রাথমিকভাবে করা হয়ে গেছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহের আগেই সম্ভবত সবকিছুর শেষ হয়ে বিবৃতি চলে আসবে। তবে এর আগে আরও কিছু কাজ সাড়তে হবে ম্যান সিটিকে।

জার্মান ক্লাব বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে ৭৫ মিলিয়ন ডলারের আশেপাশের একটা অর্থ পরিশোধ করতে হবে ইংলিশ পরাশক্তিদের। আনুসাঙ্গিক কাজগুলো শেষ হয়ে গেলেই হাল্যান্ড হয়ে যাবেন ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়। এসব কিছুই হয়ত জানেন। নতুন করে আবার একটু জানিয়ে দেওয়া আরকি। তবে ম্যান সিটির সাথে হাল্যান্ডের এই নতুন যাত্রাটা কেমন হতে পারে তা নিয়ে সংশয় নিশ্চয়ই রয়েছে।

সংশয় থাকাটাও স্বাভাবিক। এত কারিকারি অর্থ খরচেও যদি আশানুরুপ ফল না মেলে তবে তো অর্থ সব জলে। বিগত দুই মৌসুম ধরেই ম্যানচেস্টার সিটির প্রধান সমস্যা ছিল একজন ‘লিথ্যাল স্ট্রাইকার’। ম্যাচের রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তে যে কি না একটা সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগাবে। অবহেলায় হারাবে না সে সুযোগ। ঠিক তেমনই এক স্ট্রাইকার বলা যায় হাল্যান্ডকে।

দীর্ঘকায় এক স্ট্রাইকার। বয়সটাও তো নিতান্ত কম। কেবল ২১। এইতো সময় নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। ঠিক এমন সময়ে একজন খেলোয়াড় নিশ্চয়ই নিজের সর্বোচ্চটুকুই নিংড়ে দিতে চাইবে। আর তাতে তো আখেরে লাভবান হবে ম্যান সিটি। তাছাড়া ম্যান সিটির ডাগ আউটে থাকছেন এই শতাব্দীর অন্যতম সফলতম কোচ পেপ গার্দিওলা। তিনি নিশ্চয়ই জানেন সম্ভাবনাময় একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে কি করে তাঁর সর্বোচ্চটুকু বের করে নিয়ে আসতে হয়।

আর হাল্যান্ড ঠিক কতটা কার্য্যকর তা প্রমাণের আর বিশেষ প্রয়োজন তো নেই। বুরুশিয়ার হয়ে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ২৩ মিনিটের মাথায় তিনি হ্যাট্রিক করেছিলেন। ভাবুন তবে একবার। লম্বা লম্বা পায়ে তিনি ক্ষীপ্র গতিতে দৌড়াতে পারেন প্রতিপক্ষের রক্ষণে ছেদ ঘটিয়ে। এ সব কিছুতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। আর ম্যানচেস্টার সিটির তো প্রয়োজনই ছিল ঠিক এমন একজন স্ট্রাইকার।

মাঠের বাকি থাকা অধিকাংশ জায়গায় সিটির খেলোয়াড়দের জুড়ি মেলা ভার। গোলবারে রয়েছেন এডারসন। নিঃসন্দেহে তিনি বর্তমানে সেরা গোলরক্ষকদের একজন। তাছাড়া রক্ষণে ক্যানসেলো, ওয়াকার, রুবিন ডিয়াজদের মত খেলোয়াড় রয়েছে। মধ্যমাঠ একাই শাসন করার মত কেভিন ডি ব্রুইনা রয়েছে। আক্রমণেও রয়েছে জ্যাক গ্রিলিশ, ফিল ফোডেন, রিয়াদ মাহরেজরা।

এমন তারকায় ঠাসা দলে এসে নিশ্চয়ই হাল্যান্ডও নিজেকে আলাদা করে চেনানোর প্রচেষ্টা করবে। তবে একটা সংশয় থেকেই যায়। আদৌ কি ম্যান সিটি ডর্টমুন্ডের সেই হাল্যান্ডকে পাবে? যদি সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করা যায় তবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তুলনামূলক প্রতিযোগিতা ইউরোপের যেকোন ঘরোয়া লিগ থেকে ঢের বেশি। সে প্রতিযোগিতায় হাল্যান্ডকে খাপ খাইয়ে নিতে একটু বেগ পোহাতে হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত।

আবার যদি একটু টেকনিক্যালি চিন্তা করা যায় তবে প্রিমিয়ার লিগ আর বুন্দেসলিগার দলগুলোর খেলার ধরণও বেশ ভিন্ন। বুন্দেসলিগায় সাধারণত দলগুলোর রক্ষণরেখা উপর দিকেই থাকে। কোচরা তেমন করেই খেলাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সে সময়ে হাল্যান্ড তাঁর গতি ব্যবহার করে সহজেই রক্ষণে ছেদ ঘটিয়ে গোলরক্ষকের সাথে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

আর হাল্যান্ড খুবই চতুর একজন স্ট্রাইকার। তিনি যানেন গোলকিপারকে কি করে বোকা বানাতে হয়। তবে প্রিমিয়ার লিগের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে নামকরা সব কোচদের আনাগোনা। তাঁদের সবারই ভিন্ন সব পরিকল্পনা। তবে অধিকাংশ কোচই তাঁদের রক্ষণ পোক্ত রেখেই আক্রমণ সাজাতে পছন্দ করে। সেদিক থেকে হাল্যান্ড ফাঁকা জায়গা পাবেন না খুব একটা তা বলাই যায়।

তখন হয়ত হাল্যান্ডে গোল করার অনুপাতের হিসেব-নিকেশে গড়মিল আসতে পারে। ‘বাটার ফ্লাই ইফেক্ট’ হিসেবে হাল্যান্ডের মাথায় একটা বিশাল অংকের অর্থে এক অদৃশ্য চাপ এসে ভর করতে পারে। সে সাথে ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে ক্লাব সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যাশার চাপ তো থাকছেই। এত জটিলতা সামলে হাল্যান্ড তাঁর স্বাভাবিক খেলাটা উপহার দিতে পারবেন কি না তার জন্যে অবশ্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী মৌসুমের।

তবে এই মৌসুমেও হাল্যান্ড বুরুশিয়ার হয়ে ২৯ ম্যাচে ২৮ গোল করে ফেলেছে। তাঁকে সত্যিকার অর্থেই প্রিমিয়ার লিগের বাকি দলগুলোর সমীহ করা ছাড়া উপায় নেই। হয়ত হাল্যান্ড প্রিমিয়ার লিগের পরিবেশ, পরিস্থিতি, কুটকৌশলের সাথে মানিয়ে নিতে খানিক সময় নেবেন। তবে তিনি যদি মিশে যেতে পারেন সব কিছুর সাথে। তাহলে প্রিমিয়ার লিগের বাকি দলগুলোর জন্যে সেটা ‘অশনি সংকেত’।

আর হয়ত ম্যানচেস্টার সিটির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে আশা পূরণ করতে আর্লিং হাল্যান্ড নামক এই নরওয়েজিয়ান খেলোয়াড় অবদান রাখবে। আর বনে যাবে ক্লাবের ইতিহাসের একজন কিংবদন্তি। যেমনটি হয়েছিলেন সার্জিও অ্যাগুয়েরো। দশক হতে চলল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link