ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ নিয়ে প্রায় সবারই কম-বেশ জানা। অস্ট্রেলিয়ার এই ধনকুবেরকে বলা হয় আধুনিক ক্রিকেটের আসল কারিগর। ক্রিকেটে সর্বপ্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে তার নিজের গড়া টুর্নামেন্টে বেশ কিছু পরিবর্তনের মাঝে প্রথমবার ক্রিকেটে ব্যবহার করা হয় রঙিন জার্সি।
ক্যারি প্যাকারের ওই সিরিজ থেকেই ক্রিকেটে রঙিন জার্সির প্রচলন। ওই সিরিজ থেকেই এক দিনের ক্রিকেটের অনেকগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। সেগুলোরই একটি ছিল রঙিন পোশাক। টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়া খেলে সোনালি জার্সি পরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ গোলাপি।
টুর্নামেন্টটির প্রভাবে আশির দশক থেকেই ক্রিকেটে রঙিন জার্সির চল শুরু হয়। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখনও কেউ রঙিন জার্সি ব্যবহার শুরু করেনি। ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়া দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রঙিন জার্সি ব্যবহার শুরু করে। অবশ্য বাকি কোনো দলই তখনও রঙিন জার্সির ব্যাপারে ভাবেনি।
১৯৯২ বিশ্বকাপে প্রথমবার সব দল একসাথে রঙিন জার্সি পড়ে খেলতে নামে। এর আগের চার বিশ্বকাপই হয়েছিল সাদা পোশাকে। ৯২ এর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) সফলভাবে একাধিক রঙের জার্সির প্রচলন শুরু করে; সেই সাথে ৫০ ওভারের ফরম্যাটও।
ক্যারি প্যাকারের সিরিজের পর আশির দশকের শুরু দিকে সাদা জার্সিতে হলুদ স্ট্রাইপ দিয়ে ব্যবহার শুরু করে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম রঙিন জার্সিতে খেলেছিল দুই দল। বাকি দলগুলো তখনও সাদা পোশাকেই খেলছিল।
ঘরোয়া ক্রিকেট সহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ততদিনে মোটামুটি রঙিন জার্সির ব্যবহার অনেকটাই প্রচলিত। এরপর ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বাইরে প্রথম দেশ হিসেবে ক্রিকেটে রঙিন জার্সির ব্যবহার শুরু করে।
সিডনির স্পোর্টস ভিত্তিক পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান (আইএসসি) ১৯৯২ বিশ্বকাপে সব দেশের জার্সি বানানোর প্রস্তাব পায় এসিবির পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জন কুপার সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের জন্য রঙিন জার্সি তৈরি করেছিলেন।
রঙিন জার্সির প্রচলন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে কুপার বলছিলেন, ‘আমি স্পন্সরের বক্সে আমার এক ব্যবসায়িক পার্টনারের সাথে বসেছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি দেখছো? সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো এবং বললো বেশ কয়েকজন একসাথে রঙিন পোশাকে। আমি তাকে বললাম হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু তুমি কি জানো তুমি কি দেখতে পারছো না? তুমি দেখছো না দর্শকদের মাঝে প্রচুর সবুজ এবং হলুদ পোশাক পড়া।’
এরপর থেকে জার্সিকে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে বানানো শুরু করে কুপারের প্রতিষ্ঠান। জার্সি বিক্রি থেকে বড় অর্থ লাভের আশা করেছিল তাঁরা। সেই পরিকল্পনায় অবশ্য সফলও হয়েছিলেন তিনি।
১৯৮২ সালের রথম্যান্স কাপ সিরিজে প্রথমবার রঙিন জার্সির ব্যবহার শুরু করে নিউজিল্যান্ড। ওই বছরের শেষে ইংল্যান্ড ক্রিকেটও সাদা পোশাক থেকে খানিকটা সরে আসে। ওয়ানডে ক্রিকেটে নীল স্ট্রাইপ সম্বলিত জার্সি ব্যবহার শুরু করে ইংলিশরা। এশিয়ার বাইরের দেশগুলো ধীরে ধীরে রঙিন জার্সির ব্যবহার শুরু করলেও উপমহাদেশে তখনও সাদা পোশাকেই চলছিল ওয়ানডে ক্রিকেট।
১৯৯২ বিশ্বকাপের আগে আগে উপমহাদেশেও রঙিন জার্সির ব্যবহার শুরু হয়। হালকা আকাশী বর্ণের জার্সির সাথে সাদা ট্রাউজার আর সাদা প্যাড ব্যবহার করত ভারত। পাকিস্তান ক্রিকেট অবশ্য গাড় সবুজ পোশাকেই শুরু করে।তবে ৯২ এর বিশ্বকাপে পালটে যায় সব। লোগোর ব্যবহার শুরুর হয় জার্সিতে। সাদা প্যাড উঠে যায়, ব্যবহার হয় রঙিন প্যাড; প্রত্যেক দলের জার্সিতেই আসে ব্যাপক পরিবর্তন।
কুপার বলেছিলেন, ‘সব শার্টগুলো লোকালভাবেই তৈরি হত। আমাদের নিজস্ব প্রিন্টিং ব্যবসা ছিল। লোগো ডিজাইন সেখানেই হত। নিজেদের কারখানাতেই তৈরি হত।’
প্রায় এক যুগের মত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে জার্সি তৈরি করেছিল কুপারের প্রতিষ্ঠান। ১৯৯২ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে অস্ট্রেলিয়া দল একটি পিংক জার্সি পড়ে খেলেছিল! শ্রীলঙ্কাও প্রথমবারের মত দিবা-রাত্রির ওয়ানডে আয়োজন করে। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকাও দিবা-রাত্রি ম্যাচ খেলা শুরু করে। নিউজিল্যান্ডে ১৯৯৬ সালে, শারজাহতে ১৯৯৭ ও বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালে দিবা-রাত্রির ম্যাচ শুরু হয়। সেই সাথে জার্সিতে স্পনসরের লোগো ব্যবহারও শুরু হল সব সিরিজে।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে বাণিজ্যিকভাবে লাভের কথা চিন্তা করে সব দেশের জার্সিতে স্পনসরদের লোগো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো জার্সি রঙ নিয়ে। আয়ারল্যান্ড, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা – সব দলই প্রায় একই রঙের জার্সি পড়ায় টেলিভিশনে দর্শকদের খেলা দেখতে সমস্যা হচ্ছিল। দুই দলের জার্সি প্রায় একই হওয়ায় খেলোয়াড়দের চিনতেও ঝামেলা হচ্ছিল। মাঝে অস্ট্রেলিয়াও পাকিস্তানের বিপক্ষে এক সিরিজে গাড় সবুজ জার্সি পড়ে নামলো।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের জাতীয় পতাকার সাথে মিল রেখে জার্সি বানিয়ে খানিকটা সমালোচনায় পড়েছিল। অনেকেই জার্সি নিয়ে উপহাস করেছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে পরিবর্তন আনা হল দ্রুতই। কুপারের প্রতিষ্ঠানই জার্সি ডিজাইন করে। জাতীয় পতাকার সাথে মিল রেখেই বানানো হল জার্সি।
কুপার বলছিলেন, ‘আমরা ভাবলাম জাতীয় পতাকার সাথে মিল রেখে বানানো দরকার। পতাকার নীল রঙটাও জার্সিতে রাখা হল। আমরা সোনালি রঙের সাথে সবুজ রঙ রেখেছিলাম জার্সিতে। তবে ভেবেছিলাম যে এতে সমর্থকরা পছন্দ নাও করতে পারে, যার জন্য নীল রঙও দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা জার্সি ডিজাইনে জাতীয় পতাকার সাথে মিল রাখতে চেয়েছিলাম। এরপর জার্সিতে স্পনসরদের লোগো দেওয়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা রাখা হল। যাতে টিভিতে খেলা দেখার সময় লোগো দেখা যায়। যেমন বাঁ-হাতি ব্যাটারের জন্য জার্সির বাম পাশে ও ডান হাতি ব্যাটারের জন্য ডান পাশে লোগো রাখা হল।’
কুপারের প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জার্সির প্রচলন। ধীরে ধীরে জার্সিতে বিভিন্ন রঙের দেখা মিলতে শুরু করে। প্রত্যেক দেশই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রঙিন জার্সির ব্যবহার শুরু করে। আসে ফ্লাডলাইট, ওয়ানডেতে সাদা বলের প্রচলন। আশির দশকে শুরু, কালের বিবর্তনে এখন জার্সিতে সব আধুনিক ডিজাইন, রঙের দেখা মিলছে প্রতি সিরিজেই।