১৫ মে, ২০০২। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং বায়ার্ন লেভারকুসেন। এই ম্যাচেই বিশ্ব ফুটবল দেখেছিল জিনেদিন জিদানের বাঁ পায়ের বিখ্যাত সেই ভলি। চ্যাম্পিয়নস লীগ ইতিহাসের সেরা গোলের কল্যানে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের মিনিট বিশেক পরেই বাঁধে বিপত্তি। ম্যাচের ৬৪ মিনিটে লেভারকুসেন ফরোয়ার্ড নেভিলের সাথে সংঘর্ষ মারাত্মক আহত হন মাদ্রিদ কিপার সিজারে। বাধ্য হয়ে তার বদলি হিসেবে মাঠে নামাতে হয় এক তরুণ গোলরক্ষককে।
২১ বছরের অনভিজ্ঞ এক খেলোয়াড় তখন হঠাৎ করেই অসম্ভব চাপের সামনে। পরের আধা ঘণ্টাখানেক মাঠে কি ঘটেছে সেটি বোধহয় গোলরক্ষক নিজেও জানতেন না। তিনি কি করছেন সেটি অনুধাবনেরই সুযোগ ছিল না তার সামনে। লেভারকুসেনের একের পর এক দুর্ধর্ষ শটের বিপরীতে বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তরুণ মাদ্রিদ কিপার।
লেভারকুসেনের টানা আক্রমণে শেষ দিকে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু তরুন মাদ্রিদ কিপার যেন মানব দেয়াল হয়ে উঠলেন। ৯৬ মিনিটে কর্ণার কিক থেকে পাওয়া বলে স্ট্রাইকার বারবেতভ বক্সের ভেতর থেকে গোলে যে শটটা নিলেন, সেটাও ডান পা দিয়ে প্রতিহত করে কর্নারের বিনিময়ে দল রক্ষা করেন তিনি। অথচ ডান পা ছাড়া তার শরীরের বাকি অংশটুকু তখন ছিল গোললাইনের ভেতরে। কর্নার থেকে এবার নিচু একটা হেড, আবারও গোল লাইনে গ্লাভস হাতে প্রতিরোধ।
শেষ পর্যন্ত নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে মাদ্রিদের জাল অক্ষত রাখলেন তিনি। রেফারির শেষ বাঁশি বাজাতেই লা নভেনা জিতে নিল স্প্যানিশ জায়ান্টরা, যে জয়ের অন্যতম নায়ক সেই বদলী গোলরক্ষক। গত দুই যুগের ইউরোপীয় ফুটবলের খবর যদি আপনার জানা থাকে তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন যে উপরের চরিত্রটি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াস ফার্নান্দেজ-এর; ভক্তরা যাকে ভালবেসে সেইন্ট নাম দিয়েছিল ৷
১৯৮১ সালের ২০ মে স্পেনের মস্তোলস শহরে জন্ম ইকার ক্যাসিয়াসের। ফুটবলে হাতেখড়ি হওয়ার পর থেকেই ভালবেসে ফেলেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদকে। সেই থেকে স্বপ্ন বোনা শুরু, একদিন রিয়ালের সাদা জার্সি পরে মাঠে নামবেন তিনি। তবে অন্য অনেকের মত গোল করতে চাননি ইকার, তিনি চেয়েছিলেন গোল থামিয়ে দিতে। মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘লা ফ্যাব্রিকা’ (রিয়াল মাদ্রিদ ইয়ুথ একাডেমির পূর্বনাম)-তে যোগ দিয়ে স্বপ্ন পূরনের পথে এগিয়ে যান ইকার।
এরপর রিয়াল মাদ্রিদের বয়স ভিত্তিক দলগুলোতে করা পারফরম্যান্সের সুবাদে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগে তার অভিষেক হয়। নিজের ১৯তম জন্মদিনের মাত্র চারদিন পর ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমের অল-স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে মাঠে নামেন ক্যাসিয়াস। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ৩-০ গোলে জয়ী হওয়ায় সবচেয়ে কম বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলা ও জেতা গোলরক্ষক হওয়ার রেকর্ড গড়েন তিনি।
ফুটবলে গোলকিপারদের গড় উচ্চতার চেয়ে ক্যাসিয়াসের উচ্চতা কিছুটা কম। তবে দুর্দান্ত রিফ্লেক্স, চমৎকার পজিশনিং সেন্স এবং পা ব্যবহার করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা সম্মিলনে তিনি তার উচ্চতা ইস্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গেছেন বছরের পর বছর।
২০০২ সাল থেকে ২০১৪ সাল; প্রায় এক যুগ রিয়াল মাদ্রিদ মানেই গোলবারের নিচে ইকার ক্যাসিয়াসের সরব উপস্থিতি। অবশ্য ক্যাসিয়াসের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টায় দল হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ ছিল কিছুটা ছন্নছাড়া। ঘন ঘন কোচ ছাঁটাই, লা লিগায় বার্সেলোনার আধিপত্য, চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থতা – সব মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ তখন ম্লান। তবে এমন দলের এমন ক্রান্তিলগ্নেও ক্যাসিয়াস ছিলেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। তুলনামূলক-ভাবে অফ ফর্মে থাকা ডিফেন্স লাইন নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। কখনও আবার স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে চরম লজ্জার হাত থেকে দলকে বাঁচিয়েছেন।
অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দেখানো এই গোলরক্ষককে নিজেদের ডেরায় ভেড়াতে প্রিমিয়ার লিগের বড় বড় দলগুলো প্রায়ই যোগাযোগ করেছে। কিন্তু শৈশবের ক্লাবটি ছেড়ে অন্য কোনো ক্লাবের জার্সি গায়ে তোলার কথা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেননি ইকার ক্যাসিয়াস।
শিরোপার সাথে যেন ছিল আজীবন সখ্যতা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে একে একে জিতেছেন ৫টি লিগ শিরোপা, ২টি কোপা ডেল রে, ৪টি সুপার কোপা ডি স্পানা, ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ২টি উয়েফা সুপার কাপ, একটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ এবং ১টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ।
অবশ্য ২০১৫ সালে এক প্রকার ইচ্ছের বিরুদ্ধই রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে পোর্তোতে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি এই গোলরক্ষক। আর সেখানেই ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে জিতে নেন পর্তুগিজ প্রিমেরা লিগা এবং পর্তুগিজ সুপার কাপ।
ক্লাব ফুটবলের চেয়ে আন্তজার্তিক ফুটবলে অবশ্য বেশি উজ্জ্বল ইকার ক্যাসিয়াস। কারনটাও স্পষ্ট, তৎকালীন রিয়াল মাদ্রিদ দলের চেয়ে স্পেনের জাতীয় দল ছিল অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ন। লা রোজা দের হয়ে কনফেডারেশন কাপ ছাড়া সম্ভাব্য সব শিরোপা জিতেছেন ইকার ক্যাসিয়াস। বিশ্বকাপ, ইউরোর মত বড় টুর্নামেন্টে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ইকার।
শুধু ট্রফি জয়ই নয়, স্পেনের ক্যাপ্টেন হিসেবে ক্যাসিয়াস পুরো দলকে এক সুতোয় গাঁথার কাজটি ভালভাবেই করেছিলেন। তার সময়ে স্পেনের জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিল দুই রাইভাল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে দুই দলের রেষারেষির ব্যাপারটাকে তিনি জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে কখনোই প্রভাব বিস্তার করতে দেননি। ঠিক এই কারণেই স্পেনের সোনালী প্রজন্ম সফল হতে পেরেছিল।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ২০০৮ থেকে ২০১২, এই টানা পাঁচ বছর আইএফএফএইচএস বেস্ট গোলকিপার অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন ইকার ক্যাসিয়াস। এবং প্রতিবারই জায়গা পেয়েছিলেন ফিফপ্রো বিশ্ব একাদশে। এছাড়া একমাত্র গোল কিপার হিসেবে ২০০৭-২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ৬ বার ইউয়েফা বর্ষসেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ব্যালন ডি’অর এর তালিকায় এসেছিলেন চতুর্থ অবস্থানে। একই মৌসুমে জিতেছেন জামোরা ট্রফি। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার হিসেবে ‘গোল্ডেন গ্লোভস’ রয়েছে ক্যাসিয়াসের কেবিনেটে। লা রোজাদের হয়ে সবচেয়ে বেশি জয় এবং সবচেয়ে বেশি ক্লিনশিটের মালিকও তিনি। এমনক ইকার ক্যাসিয়াস নির্বাচিত হয়েছিলেন শতাব্দীর ২য় সেরা গোলকিপার হিসেবে।
২০১৯ সালের ১মে, পোর্তোর হয়ে ট্রেনিং করার সময় হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিতে হয় ক্যাসিয়াসকে। পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার মাঠে ফেরা নিয়ে ডাক্তাররা শঙ্কা প্রকাশ করেন। অসুস্থতার জের ধরে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ইকার ক্যাসিয়াস।
ফুটবলে গোলরক্ষকরা এমনিতেই আক্রমন ভাগের খেলোয়াড়দের তুলনায় পাদপ্রদীপের আলো খুব একটা পান না। এজন্যই হয়তো ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোল নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, তার সিকিভাগও হয় না আরিয়েন রোবেনকে দুইবার অতিমানবীয় দক্ষতায় থামিয়ে দেয়া ইকার ক্যাসিয়াসকে। অথচ এমন প্রতিরোধ না দেখালে হয়তো বিশ্বকাপই জেতা হত না স্পেনের।
কিছু মানুষ এমনই হয়, তাদের এমন হতে হয়। তারা মেঘের আড়াল থেকে নিজের কাজটুকু করে যায় নিরলসভাবে। তবু এখন কিংবা কয়েক প্রজন্ম বাদেও কেউ যদি সেরা গোলরক্ষকদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে, নিশ্চিতভাবেই একজন সেইন্টের কথা বলতে হবে, বলতে হবে একজন ইকার ক্যাসিয়াসের গল্প।