টেস্ট ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের বিবর্তন

২০১৫ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল নিউজিল্যান্ড। টেস্ট ক্রিকেটের সেরা দল এখন নিউজিল্যান্ড। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের পর এবার টেস্টেও নিউজিল্যান্ডের কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা নিয়ে চায় ইংলিশরা।

কিন্তু, নিউজিল্যান্ডের এই সাফল্যের পেছনে আসল ঘটনা কি? একটা সময় টেস্টে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার দাপটের সামনে দাঁড়াতে পারত না কোনো দল। সেই দলগুলো ছাপিয়ে টেস্টে এখন নিউজিল্যান্ড সেরা এক দল। টেস্টে নিউজিল্যান্ডের এই পরিবর্তনের পেছনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা যাক।

  • ক্রিকেটের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি

১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের সাবেক তিন ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় গাঁজা সেবনের কথা শিকার করলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং। অবশ্য পরে তিনি বলেছিলেন, ‘দলের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড় এর সাথে জড়িত ছিল।’

এরপর শুরু হয় ঝামেলা। এই ঝামেলার ফলে বোর্ডেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। সেসময় নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের ১৩ জন সদস্য ছিলেন, যাদেরকে ছয়টি প্রদেশ থেকে নেওয়া হয়েছিল। আর এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অবৈতনিক। দ্য হুড রিপোর্ট তখন বোর্ড প্রধানদের মিটিংয়ে বললেন, একটি ট্রিমার বোর্ড গঠন করতে। যাদেরকে কাজের জন্য বেতন দেওয়া হবে। এবং এই কাজের জন্য সেরা লোকদের বাছাই করা হবে।

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট তখন প্রাদেশিক সমিতি গুলোর স্বার্থ বাদ দিয়ে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের স্বার্থ চিন্তা করেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করে। নতুন কমিটি ক্রিকেটে উন্নতির জন্য সেরাটা দিয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে ক্রিকেটারদের তুলে আনতেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সালে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট ক্রিকেট ম্যাক্স চালু করে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (এনজেডসি)। মার্টিন ক্রো এই ফরম্যাটের আবিষ্কার করেন।

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের কাঠামো পরিবর্তন হয় ব্যাপক। বোর্ডে সরকারের হস্তক্ষেপের অভিযোগ জানিয়ে পরবর্তীতে এক সিরিজ বয়কট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ভাবে নিতে বোর্ডের ৪১ টি সদস্যের মতামত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৮ টি প্রথম শ্রেণির কাউন্টি, মেরিলেবন ক্রিকেট ক্লাব, ২১ টি জাতীয় কাউন্টি ও জাতীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আছে।

  • ঘরোয়া ক্রিকেটে পেশাদারিত্ব

২০০০ সালে নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবাইকে সেমি-পেশাদার বলা হত। শুধুমাত্র জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের পেশাদার ক্রিকেটার বলা হত। এটার কারণে দলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই বেতন ভাতা ঠিকমত না পাওয়ায় বেশ অল্পতেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান।

২০০১ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (এমজেডসিপিএ)। বোর্ডের আয়ের একটা অংশ খেলোয়াড়দের দেওয়া হবে এমন নিয়ম করা হল। সেখান থেকেই নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের নতুন যুগের শুরু।

বর্তমানে ১১৬ জন পেশাদার ক্রিকেটার আছে নিউজিল্যান্ডে। প্রত্যেক প্রদেশের আছে ১৬ জন করে, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আছে ২০জন। একজনের পেছনে একাধিক অপশনও আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক ইনিংসে সাত উইকেট নেওয়া ম্যাট হেনরি, যিনি নিজের শেষ তিন টেস্টের দু’টিতে ম্যাচ সেরা হয়েছেন – লর্ডস টেস্টে ইংলিশদের বিপক্ষে একাদশেই সুযোগ পাননি।

  • ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন

২০০১ সালের আগে কোচরা ঘরোয়া ক্রিকেটে শুধুমাত্র গ্রীষ্মে কোচিং করাতেন। এখন অবশ্য ফুল-টাইম কাজ করেন। কোচিং পেশাকেও এখন বেশ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়। এই কোচদের মাধ্যমেই উঠে আসছে তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা। খেলোয়াড় ও কোচদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট অবকাঠামো উন্নয়নও করেছে বেশ।

২০০২-০৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট ২৪টি ভিন্ন ভিন্ন মাঠে খেলা হয়েছিল। যার মধ্যে ছয়টি প্রদেশ ক্রিস-ক্রসিং পদ্ধতিতে নিজেদের শহরের ছোট ছোট ভেন্যুতে খেলেছিল। এরপর ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের পক্ষ থেকে ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য আলাদা আলাদা মাঠে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনুশীলন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের জন্য বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করা হয়।

পিচগুলোতেও বেশ পরিবর্তন আনা হয় সাধারণ সবুজ ঘাসের উইকেট দেখা গেলেও ব্যাটারদের জন্য ফ্ল্যাট উইকেটও তৈরি করা হয়েছে। ২০১০ সালের পর ব্যাটিংয়েও বেশ উন্নতি দেখা গেছে ব্যাটারদের। নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের ব্যাটিং গড় যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।

  • ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জোয়ার এড়ানো

২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চালুর পর। ভারতের বাইরের ক্রিকেটারদের বাড়তি একটা ভাল সুযোগ তৈরি হল। তাও আবার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে মোটে অংকের টাকা। কিন্তু অনেকেই এই বাস্তবতা নিরিখ করতে ভুল করে। ২০১৫ সাল অবধি আইপিএলকে গুরুত্বই দেয়নি ইংল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাধ্যতামূলকভাবে তাদের ক্রিকেটাদের ঘরোয়া লিগে খেলার জন্য চাপ দিচ্ছিল। যার জন্য ক্রিকেটারদের অনেককেই জাতীয় দলে পায় না বোর্ড।

২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান তারকা এবি ডি ভিলিয়ার্স আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান। তিনি চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগেও খেলতে। তবে সেটি নিয়ে বোর্ডের সাথে ঝামেলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই তারকা।

তবে ব্যতিক্রম ছিল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট। তারা তাঁদের ক্রিকেটারদের ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলার অনুমতি দিয়েছিল। এতে নতুনরা দলে সুযোগ পেয়ে কাজেও লাগিয়েছে। দলের ডেপথ বেড়েছে। এতে নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগীও বেড়েছে বেশ। বিপরীতে প্রত্যেক দেশ ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট চালু করতে গিয়ে অনেকেই লোকসানের মুখেও পড়েছে।

আইসিসির ১২টি দলের মধ্যে একমাত্র নিউজিল্যান্ড কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট তৈরির চেষ্টাই করেনি। আইপিএল সহ ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা এই ক্রিকেটারদের দিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ উন্নতি করেছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট।

  • জাতীয় দল সবার আগে

লর্ডসে প্রথমবারের মত তিনে ব্যাট করতে নামেন ইংলিশ ব্যাটার ওলি পোপ। তিনে নেমে দ্বিতীয় টেস্টেই দেখা পেয়েছেন ক্যারিয়ারের মেইডেন সেঞ্চুরির। মিডল অর্ডার থেকে উপরে উঠে এসে দেখা পেয়েছেন সাফল্যের। নিউজিল্যান্ডের বিজে ওয়াটলিং, টম ল্যাথামরাও এভাবে নিজেদের পজিশন পরিবর্তন করে সাফল্যের আলোর দেখা পেয়েছিলেন টেস্টে।

জাতীয় দলের সাথে সাথে ঘরোয়া ক্রিকেটকেও বেশ প্রাধান্য দিয়েছে নিউজিল্যান্ড। অভিজ্ঞ কোচ সহ খেলোয়াড়দের স্যালারি কাঠামো সবকিছুর পেছনে মূল কারণ দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি। ক্যান্টারবুরির ওপেনার টম ল্যাথামকে নিউজিল্যান্ডের কোচ মাইক হেসন বলেছিলেন ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডারে স্যুইচ করতে। এরপর মিডল অর্ডারে অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পান ল্যাথাম।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটার বিজে ওয়াটলিং ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন ওপেনার। সেখান থেকে কোচের পরামর্শে নেমে আসেন মিডল অর্ডারে। নিউজিল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটার বনে যান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link