ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ওয়ানডে ব্যাটসম্যানদের র্যাংকিংয়ে সবার উপরে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও একই দৃশ্যপট। অন্যদিকে টেস্ট ব্যাটারদের আইসিসি র্যাংকিংয়ে চার নম্বরে অবস্থান। পাকিস্তান তো বটেই, বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজমের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে আইসিসির এই তালিকাগুলোই যথেষ্ট।
একটা সময় ভারতের বিরাট কোহলি ছিলেন সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান। নিজের এই আধিপত্য অনেক দিন ধরে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে ম্লান শুরু করেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক।
অন্যদিকে জহির আব্বাস, জাভেদ মিয়াদাঁদ, ইনজামাম উল হকদের উত্তরসূরী হয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় পা রাখা বাবর আজম পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে ক্রমাগত উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
তাই তো অভিষেকের পরে যাকে ভাবা হতো পাকিস্তান ক্রিকেটের নেক্সট বিগ থিঙ, সেই বাবর আজম এখন রাজ করছেন বাদশাহ বাবরের মতই।
দারুণ বোলিং আক্রমণ, চরম প্রতিকূল পরিবেশ,ব্যাটারদের জন্য ফাঁদ পাতা পিচ; এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই যদি হয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই তবে পাকিস্তানের বর্তমান অধিনায়ক তাতে পাশ করেছেন লেটার মার্কসহ। রানসংখ্যা পাশে সরিয়ে রাখি; দল যখন চাপের মুখে,প্রতিকূল পরিবেশে তখন বাবরের পারফরম্যান্সই বলে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কথা।
ঘরের মাঠের চেনা কিংবা অ্যাওয়ে-তে অচেনা পরিবেশ; কোথাও থমকে দাঁড়ায় নি এই ডানহাতির ব্যাটের হাসি। শক্তিশালী বোলিং আক্রমণ কিংবা খর্বশক্তির বোলিং আক্রমণ তাঁর ব্যাট থেকে ছাড় পায়নি কোন দলই।
সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই ভাবা যাক। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার হয়তো আব্দুল্লাহ শফিক পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু প্রথম ইনিংসে ৮৫ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়া পাকিস্তানকে লড়াইয়ে রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন বাবর। লেজের ব্যাটসম্যানদের সঙ্গী করেই শাসন করেছিলেন লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের। শেষ ব্যাটসম্যান নাসিম শাহয়ের সঙ্গে গড়েছেন ৮০ রানের জুটি, যেখানে নাসিমের অবদান মাত্র ৫ রান।
আর এই জুটি গড়ার পথেই নিজের সপ্তম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন বাবর আজম। এখানেই থেমে যাননি এই তারকা, দ্বিতীয় ইনিংসে দল যখন ৩৪২ রানের লক্ষ্য জয় করার চেষ্টায় মত্ত তখনও দারুণ এক অর্ধশতকে পথ দেখিয়েছিলেন তিনি।
এই একম্যাচ আসলে বাবর আজমের পুরো ক্যারিয়ারের একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানি এই ক্রিকেটার যে দায়িত্ব নিয়ে খেলতে জানেন, চাপের মুহূর্তে জেতাতে জানেন সেটি আরেকবার প্রকাশ হলো। এরই সাথে গল টেস্টে বাবরের যোগ্য নেতৃত্ব ফুঁটে উঠেছে বার বার। সাহসী অধিনায়কত্ব, দুর্দান্ত ব্যাটিং মিলে বাবর আজম এখন নি:সন্দেহে সময়ের সেরা ক্রিকেটারদের একজন।
২০১৬ সাল থেকে বাবর আজমের সখ্যতা গড়ে উঠে রানের সাথে। ২০১৬ সালের পর থেকে প্রায় প্রতি বছর টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে ফরম্যাটে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি, আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও শীর্ষ ব্যাটারদের তালিকায় উপরের দিকে ছিলেন এই পাকিস্তানি ক্রিকেটার।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আগেই নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যান হয়েছিলেন; ২০১৮ সালে টি–টোয়েন্টি আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। আর দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর গত বছরে বিরাট কোহলিকে ছাড়িয়ে পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটারের মর্যাদা লাভ করেন লাহোরের সন্তান।
চলতি বছরেরও থেমে নেই তাঁর রান ফোয়ারা। ২০২২ সালে সাদা পোশাকে এখন পর্যন্ত সাত ইনিংস ব্যাট করা বাবর ৮০.৫৭ গড়ে ৫৬৪ রান করেছেন। দুইটি সেঞ্চুরি আর তিনটি হাফসেঞ্চুরি আছে তাঁর অর্জনের খাতায়। এছাড়া ওয়ানডেতে ৬ ইনিংসে ব্যাট করেছেন ৯১.৪০ গড়ে।
তিনটি শতক আর দুইটি অর্ধশতকে মোট ৪৫৭ রান করেছেন এই ব্যাটার। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে কোন তিন অঙ্কের দেখা না পেলেও তিনটি ফিফটি করতে পেরেছেন। আর প্রায় ৪১ গড়ে ৪০৯ রান করে প্রমাণ দিয়েছেন কেন তিনি সবার সেরা!
বাবর আজম নামক সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়ে এখন মধ্য আকাশের দিকে আসছে; তেজদীপ্ততার সাথেই নিজের অস্তিত্বের ঘোষনা দিয়ে যাচ্ছে। বয়ে বেড়াচ্ছে তেজস্বী এক ক্রিকেটীয় অধ্যায়। বর্তমান সময়ে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তিনিই সেরা।
তবু কিংবদন্তি হওয়ার দৌঁড়ে এখনও পিছিয়ে বাবর আজম। যেমন পারফর্ম করে যাচ্ছেন তিনি, তার জন্য অবশ্য এই পথ অতিক্রম করা খুব একটা কঠিন হওয়ারও কথা নয়। আর এর জন্য বাবরকে বেছে নিতে হবে এক কঠোর সংগ্রামের পথ; যে পথে তাকে হাঁটতে হবে একা। ফিটনেস থেকে পারফরম্যান্স সব হতে হবে নিঁখুত; তবেই তিনি সর্বকালের সেরাদের কাতারে নিজের স্থান খুঁজে নিতে পারবেন।