‘ক্লাস অব ৯২’ – ফুটবলের খুব পরিচিত একটা টার্ম। কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাল জার্সি এবং সাদা শর্টস পরিহিত একদল তরুণ খেলোয়াড় নব্বইয়ের দশকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে যারা দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। ডেভিড বেকহ্যাম, রায়ান গিগস, গ্যারি নেভিল এবং পল স্কোলসরা আজকে ক্লাবের কিংবদন্তি।
তাঁদের ফুটবল ক্যারিয়ার অনেকের জন্যই আজ স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তরুণ এই খেলোয়াড়দের তারকা হয়ে ওঠার পেছনের কারিগর হলেন এরিক হ্যারিসন যুব দলে থাকার সময় তার অধীনেই খেলতেন এই ফুটবলাররা।
এরিক জর্জ হ্যারিসন নামটা খুবই অপরিচিত। তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন ছিল খুব সাদামাটা। ১৯৫৭ সালে স্থানীয় দল হ্যালিফ্যাক্স টাউনে ক্যারিয়ার শুরু করে ১৯৭২ অবধি খেলেছেন হার্টলপুলস ইউনাইটেড, ব্যারো, সাউথপোর্ট এবং স্কারবোরোতে।
১৯৮১ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তৎকালীন কোচ রন অ্যাটকিনসন এভারটন থেকে এরিক হ্যারিসনকে রেড ডেভিলদের যুব দলের কোচ হিসেবে নিয়ে আসেন। ১৯৮৬ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ওল্ড ট্রাফোর্ডের দায়িত্ব নিলেও হ্যারিসনকে তার পূর্বের জায়গায় বহাল রাখেন। এ সময় এরিক হ্যারিসন এবং স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বৈঠক করে রেড ডেভিলদের স্কাউটিং দলে বিশাল রোড বদল আনেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুব দলের জন্য ভাল মানের খেলোয়াড় খুঁজে বের করা।
১৯৯২ সাল, এই বছরটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসে গভীরভাবে খোঁদাই করা। এই বছরেই হ্যারিসন তার কর্মফল পেয়ে যান। হ্যারিসন ইংল্যান্ডের কিছু তরুণ খেলোয়াড়দের পরিচর্যা করেন এবং তাদের যুব শিরোপা বিজয়ী করে তোলেন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই খেলোয়াড়দের মাঝে বিশ্বাস তৈরি হয় যে তারা মূল দলে জায়গা করে নিতে পারবে। একই সাথে অল্প বয়স থেকেই তাদের মধ্যে বিজয়ী হওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে।
হ্যারিসন শুধুমাত্র একজন ফুটবল কোচ ছিলেন না, এই তরুণ ফুটবলারদের জীবনের শিক্ষক ছিলেন তিনি। হ্যারিসনের কোচিং দর্শন সম্পর্কে গ্যারি নেভিল বলেন, ‘অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও হাল ছেড়ে না দেওয়া তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন। বছরের পর বছর ধরে রেড ডেভিলদের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে হ্যারিসনকে ‘মেম্বার অফ দ্য অর্ডার অফ দা ব্রিটিশ এম্পায়ার’ পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। পর্দার আড়ালের একজন মানুষের এই ধরণের স্বীকৃতি পাওয়ার থেকে বোঝা যায় যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যুবকদের জীবন এবং খেলার উপর তিনি কতটা প্রভাব ফেলেছিলেন। পর্দার আড়ালে থেকেও রেড ডেভিলদের সাফল্যের পেছনে তার কি পরিমাণ অবদান ছিল এই পদক তারই বহি:প্রকাশ।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও এই হ্যারিসনের তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাল চরিত্র এবং দৃঢ় সংকল্প স্থাপন করার ক্ষমতার প্রসংশা করেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমি ম্যানেজার হিসেবে দলে আসি তখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। কারণ আমি হ্যারিসনকে ক্লাবের স্টাফ হিসেবে পেয়েছিলাম। ওর কাজ খুব কাছ থেকে দেখতে পাই। হ্যারিসন খেলোয়াড়দের মধ্যে চরিত্র এবং সংকল্প তৈরি করেছিল। ভবিষ্যতের জন্য ওদের প্রস্তুত করেছিল।’
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের চোখেও হ্যারিসন ছিলেন ফুটবলের বিরাট এক শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘হ্যারিসন একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি তার খেলোয়াড়দের সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন। তরুণ খেলোয়াড়দের ভাল মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার এবং সেই সাথে ভাল ফুটবলার হিসেবে তৈরি করার ক্ষমতা ছিল হ্যারিসনের যা তাকে তাদের সময়ের অন্যতম সেরা কোচ করে তুলেছিল।’
২০১৭ সালে হ্যারিসনের স্মৃতিভ্রংশ রোগ ধরা পড়ার পর তার সাথে দেখা করেছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার বলেন, ‘আমি এখনও হ্যারিসনের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমাকে হলিউড স্টাইলের পাসগুলি খেলতে মানা করছেন। হ্যারিসন ক্লিফ ট্রেনিং গ্রাউন্ডে যখন আমাদের খেলা দেখতেন তখন আমাদের মুখে গর্বের হাসি ফুঁটে উঠত। হ্যারিসন জানালা দিয়ে আমার খেলা দেখার সময় জানালায় তাঁর মুঠির জোরে ধাক্কা দিতেন। এটাই নির্দেশ করতো যে, যে কোনো মুহূর্তে তিনি পরামর্শ দিতে আসবেন। আমি জানতাম যে তিনি সেই পাসগুলি খেলা বন্ধ করার জন্য বলবেন।’
হ্যারিসন বেকহ্যাম ও অন্যান্যদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে কীভাবে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, একে অপরকে সম্মান করতে হয়, তা হোক ফুটবল মাঠে এবং তার বাইরেও। তিনি তাদেরকে জীবনের যে শিক্ষা দিয়েছেন তা তারা কখনো ভুলবেন না।
রবি স্যাভেজ ‘ক্লাস অফ ৯২’ -এর আরেক সদস্য যিনি তার সতীর্থদের মত সফল হতে পারেননি। মূল দলে খেলার আগে ইউনাইটেড থেকে চলে গিয়ে স্যাভেজ তার ক্যারিয়ারে লিস্টার, বার্মিংহামের মত ক্লাবে খেলেছেন। তার কাছে এখনও হ্যারিসনের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি রয়েছে যা তাকে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল।’
স্যাভেজ বলেন, ‘হ্যারিসন ও আমার পরিবারের কারণে আমি ফুটবল ছাড়িনি। হ্যারিসন বলেছিলেন যে তিনি আমার ফুটবলীয় দক্ষতায় বিশ্বাস করেন। তার প্রতি আজও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি আমি। আমার জীবনের শিক্ষার একটি বড় অংশ এসেছে হ্যারিসনের কাছ থেকে।’ ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছর বয়সে এরিক হ্যারিসন মৃত্যুবরণ করেন।
ফুটবল এখন টাকার খেলা। দলবদলের বাজারে চরা দাম দিয়ে খেলোয়াড় কেনার দিকে মনযোগী বড় বড় সব ক্লাব গুলো। একাডেমি থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের এখন সাধারণত ধারে অন্য ক্লাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর নিজ ক্লাবের ২৩ সদস্যের দলে জায়গা পেলেও মুলত তা উয়েফা বা লিগের দেওয়া ক্লাবে বড় হয়েছে বা স্বদেশী এই কোঠা পূরণের জন্য।
এখানে তারা বেঞ্চ গরম করা ছাড়া খেলার সুযোগ পায় খুব কমই। দুই একজন খেলোয়াড় যে মূল একাদশের অংশ হন না তা নয় কিন্তু একাডেমির খেলোয়াড়দের পরিচর্যা করার বদলে ‘রেডি মেড’ খেলোয়াড়ই বেশি চায় ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো।
এখনকার সময়ে এসে তাই নি:সন্দেহে বলা যায় আরেকটি ‘ক্লাস অব ৯২’ হয়তো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে দেখা যাবে না। তবে এরিক হ্যারিসনের মত কারো হাত ধরে যদি এর পুনরাবৃত্তি দেখা দেয় তবে আকশ পানে চলে যাওয়া এরিক হ্যারিসনের চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।