ফুটবলের জার্মান দেবতা

ফুটবল দেবতার তকমা জুড়ে যায় একটা সময় তাঁর নামের পাশে। তবে এই দেবতা হওয়ার যাত্রাটায় হুট করেই নিজেকে আবিষ্কার করেছেন বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার, বিষয়টা তেমনও নয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এই পথে ভালবাসার লাল রঙে নিজেকে রাঙিয়েছেন। ফুটবলের সবুজ ঘাসটায় নিজের জীবনের সোনালী দিনগুলো পার করেছেন তিনি।

মিউনিখ শহরের অদূরে ১৯৮৪ সালের পহেলা আগস্ট জন্মেছিলেন মিডফিল্ডের এই জার্মান কারিগর। সে শহরটা তাঁকে একটা মায়ার বাঁধনে। এই শহরেরই সবচেয়ে শক্তিশালী ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ। এই ক্লাবের লাল রঙা জার্সিতেই অর্জনের ফুলঝুরি ফুটিয়েছেন শোয়েনস্টেইগার। এই ক্লাবটাই তাঁকে নীলাম্বরে উড়ে বেড়ানোর সুযোগটা করে দিয়েছিল, আর দিয়েছিল একগুচ্ছ মানুষের অগাধ ভালবাসা আদায়ের সুযোগ।

মাত্র ছয় বছর বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবলের সাথে সম্পৃক্ততা শুরু শোয়েনস্টেইগারের। বড় ভাইকে দেখেই সম্ভবত অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই হয়ত শোয়েনস্টেইগারের পরিচয় ঘটে ফুটবল নামক এক আবেগে মোড়ানো ক্রীড়া জগতের সাথে। সে আবেগ বন্ধন থেকে আর নিজেকে যেন আলাদাই করতে পারেননি শোয়েনস্টেইগার।

তবে বড় ভাই খুব বেশি সফলতার দেখা পাননি। মুদ্রার অন্যপিঠে সফলতার সব গল্পই যেন লেখা হয়েছিল শোয়েনস্টেইগারের জন্য। বায়ার্ন মিউনিখের লাল জার্সিটা ঠিক যেন পাপড়ি মেলা এক জবা ফুল। সে ফুলের সৌরভের তো ইউরোপিয়ান ফুটবলের বহু আগে থেকেই বিচরণ। আর সে সুবাতাসে নিজের ফুটবল সামর্থ্যের সমস্তটুকু ঢেলে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি শোয়েনস্টেইগার।

কিন্তু চিত্রপটটা একটু ভিন্ন হলেও হতে পারত। বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগারের নামটা হয়ত একজন স্কি রেসার হিসেবেই আলোচিত হতে পারত। তাঁর বাবার একটা ক্রীড়া সামগ্রীর দোকান ছিল। সে সুবাদে বহু মানুষের সাথে পরিচয় তাঁর বাবার। শোয়েনস্টেইগারের একজন বন্ধু ছিলেন যিনি জার্মানির হয়ে তিনবার শীতকালীন অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন একজন স্কি রেসার হিসেবে। বাবার একটু চোখ রাঙানি নিশ্চয়ই তাঁকে নিয়ে ফেলে দিত পারত শুভ্র তুষার সাগরে।

তবে তেমনটা আর ঘটেনি। তিনি বরং সবুজের মাঝেই খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের সমস্ত সুখ। আর সে সুখের অংশ বিশেষ ছড়িয়ে দিয়েছেন গোটা জার্মানি থেকে শুরু করে বায়ার্ন সমর্থকদের মাঝে। তাইতো বাভারিয়ানরা তাঁকে আদর করে ‘ফুটবল গড’ তকমা জুড়ে দিয়েছিল তাঁর শরীরে। ১৭টা বছর তিনি ছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের মধ্যমাঠে।

প্রায় দুই দশক। এ তো এক মায়ার জগৎ। এখান থেকে বের হওয়া তো প্রায় দুষ্কর। এই ১৭ বছরের কত জয় পরাজয়ের সাক্ষী শোয়েনস্টেইগার! কত জয়ের কারিগরও যে তিনি! কত হাসি-কান্নার সঙ্গী বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার! সে ফিরিস্তি কি আর লিখে শেষ করা যায়! যায় না। ফুটবল বিধাতা দু’হাত ভরেই দান করেছিল তাঁকে। রক্তিম ওই জার্সি গায়ে তিনি আটখানা লিগ টাইটেল জিতেছেন। শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবেন তিনি তেমনটা ভাবা নেহায়েৎ বোকামি।

ডিবিএফ কাপ তিনি জিতেছেন সাত বার। একবার ইউরোপের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটও পড়েছেন সতেরো বছরের দীর্ঘ এক যাত্রায়। ক্লাব বিশ্বকাপও একবার জেতা হয়েছে তাঁর। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে বিশ্বকাপকেই হয়ত এগিয়ে রাখবেন শোয়েনস্টেইগার।

২০১৪ সালের সে অভাবনীয় বিশ্বকাপ স্মৃতি কি করে ভুলে যাবেন তিনি! মারিও গোৎজের আকস্মিক গোলে একবিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়কে চোখের জলে ভাসিয়ে শিরোপা উল্লাস করেছিল জার্মানি। সে উৎসবের স্রোতে সেদিন শোয়েনস্টেইগারও নিজেকে ভাসিয়েছিলেন। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।

তবে সতেরো বছরের মায়া ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিও গায়ে জড়িয়েছিলেন বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার। আবারও রক্তিম জার্সি। দূর আকাশে অস্ত যাওয়ার সূর্যটা যেন কোন ভাবেই পিছু ছাড়ে না শোয়েনস্টেইগারের। ইংলিশ ক্লাবটার হয়েও বেশ ক’বার শিরোপা জিতেছেন তিনি। শেষমেশ আমেরিকার ক্লাব শিকাগো ফায়ারের হয়ে খেলে তিনি সবুজ গালিচার মায়া ত্যাগ করেছিলেন।

তবে কাঠের একটা ফ্লোর খুব করে টানতো তাঁকে। বাস্কেটবলের একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি আজীবন। তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাও তো খেলতেন পেশাদার পর্যায়ে বাস্কেটবল। তবে সবকিছু ছেড়ে তিনি বনে গেছেন জার্মান ফুটবলের কিংবদন্তি। ক্লাব কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব শক্তিশালী দুই দলের হয়ে মাঠ মাতিয়ে কিংবদন্তি বনে যাওয়ার পথটা কঠিন। বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার সেটা করেছেন। দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link