তারকা ফুটবলার, বিশ্ব সেরা ম্যানেজার, রেলিগেটেড ক্লাবের জন্য প্যারাসুট পেমেন্ট সিস্টেম এবং ৯০ মিনিট উত্তেজনায় ভরপুর ফুটবল ম্যাচ এর সবই আপনি পাবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। অনিশ্চয়তায় ভরপুর মুহূর্তগুলো আপনাকে পুরো ম্যাচ জুড়েই বুদ করে রাখবে তা ছোট বা বড় যেই ক্লাবের খেলাই হোক না কেন, আর এটাই প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে বড় সেলিং পয়েন্ট।
আর্থিকভাবে শক্তিশালী এই লিগকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা লিগ বলাই যায় যা গত ১৫ আগস্ট প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরে পদার্পণ করেছে। কিভাবে প্রিমিয়ার লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল? কিংবা কেন এই লিগ গঠনের প্রয়োজন হয়েছিল? তার মূল কারণ গুলো নিয়েই আজকের আয়োজন।
১৯৯২ সালের ১৫ আগস্ট, ১০৪ বছরের পুরানো ঐতিয্যবাহী ফুটবল লিগের পিরামিড থেকে বেরিয়ে ইংল্যান্ডের প্রথম বিভাগের ২২টি দল নিয়ে গঠিত হয় নতুন টপ ফ্লাইট লীগ যার নাম দেওয়া হয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। মজার ব্যাপার হল প্রিমিয়ার লিগ নামকরণের আগে একে সুপার লিগ নাম দেওয়া হয়েছিল যা পড়ে পরিবর্তন করা হয়। তিন দশক আগে যখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চালু করা হয়েছিল কেউ হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে তা আজকের এই বিশাল মহীরুহে পরিণত হবে।
প্রিমিয়ার লিগ আমলে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা প্রথম ম্যাচে নটিংহাম ফরেস্টের হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে গোল করেছিলেন ফরেস্টের স্টাইকার টেডি শেরিংহাম। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগে আমরা কেউ আসলে বুঝতে পারিনি প্রিমিয়ার লিগ এমন বিশাল কিছু হবে।’
টেলিভিশন সম্প্রচার সত্ত্বের টাকা পুরো ৪ বিভাগের সব দলের মাঝে সমান ভাবে বণ্টন করার বদলে যাদের কারণে আয় বেশি হচ্ছে সেই প্রথম বিভাগের দলগুলোকে সেই টাকার বেশির ভাগ অংশ দেওয়া জন্য তৎকালীন ‘বিগ ফাইভ’ ক্লাব আর্সেনাল,ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, এভারটন এবং টটেনহাম হটস্পারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই নতুন লিগের প্রস্তাব তুলেন। এছাড়াও ইংল্যান্ডের তৎকালীন ফুটবল কালচারের সার্বিক পরিবরতনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তাই বলাই যায় প্রিমিয়ার লিগ ছিল সময়ের দাবি।
৭০ এবং ৮০’র দশকে হুলিগানিজম এবং আর্থিক অব্যাবস্থাপনার কারণে ধুকতে থাকে ইংলিশ ফুটবল লিগের দলগুলো। একের পর এক স্টেডিয়াম দুর্ঘটনার জের ধরে ১৯৮৫ সালে লিভারপুলকে ৬ বছর এবং বাকি সকল ইংলিশ ক্লাবকে ৫ বছরের জন্য সকল প্রকার ইউরোপিয়ান ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৮৯ সালের হিলসবরো ট্র্যাজেডির পর টেইলার রিপোর্টে বলা হয় যে স্টেডিয়াম গুলোর আধুনিকায়ন এবং সর্বোপরি ফুটবল কাঠামোর আধুনিকায়নের কথা। আরেকটি গুরত্তপূর্ণ ব্যাপার হল পাওয়ার স্টাগলকে কেন্দ্র করে এসময় ইংলিশ ফুটবল লিগ এবং ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, আর এই সব সুযোগকে কাজে লাগিয়েই বিগ ফাইভের কর্তারা তৎকালীন ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান গ্রাহাম কেলির কাছ থেকে প্রিমিয়ার লীগ গঠনের গ্রিন সিগনাল আদায় করে নেন।
প্রিমিয়ার লীগ মূলত আর্সেনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডেভিড ডিনের ব্রেইন চাইল্ড বলা যায়। স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ান লীগ থেকে পিছিয়ে পরা ইংলিশ ফুটবলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাণিজ্যিক দূরদর্শিতার অভাব তাকে ভাবিয়ে তোলে। ইংলিশ ফুটবল লিগের কর্তা ব্যক্তিরা ভাবতেন টেলিভিশনে ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার করা হলে মাঠে দর্শক সংখ্যা কমে যাবে এবং ক্লাব গুলোর আয় দিন দিন কমতে থাকবে।
অপরদিকে আমেরিকান ফুটবলের বাণিজ্যিক কাঠামো ডিনকে আকৃষ্ট করতো, তিনি মনে করতে ভবিষ্যতে ফুটবলের মূল আয় হবে স্পন্সরশিপ এবং সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে। তাই অনেকদিন ত্থেকেই তিনি এই ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিলেন।
ডেভিড ডিনের পরিকল্পনায় যে কোন ভুল ছিল না তা বলাই যায়, রুপার্ট মারডকের স্কাই টেলিভিশনের কাছে প্রিমিয়ার লিগের সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রির পর থেকেই বছর পর বছর টাকার অঙ্কটা বেড়েই চলেছে। টাকার ঝন ঝনানির পাশাপাশি দর্শকদের বিনোদনের জন্য আমেরিকান ফুটবলের আদতে বানানো অনুষ্ঠান মান্ডে নাইট ফুটবলের সফলতা নিয়ে শুরুতে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করলেও বর্তমানে তা ছাড়া প্রিমিয়ার লিগ কল্পনাই করা যায় না।
সম্প্রচার সত্ত্বের কল্যাণে ক্লাব গুলো তারকা ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয় যা আগে খুব একটা হত না বরং ইংলিশ লিগের তারকা ফুটবলাররা স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ান লিগে যেতেই বেশি মনযোগী ছিল। এছাড়া টেলিভিশনে খেলা দেখানোর ফলে ক্লাবগুলো বিশ্বব্যাপী নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যা তাদের নতুন সব স্পন্সসর ডিল পেতে সাহায্য করে এবং তাদের ব্রান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি করে।
বর্তমানে ১৮৮টি দেশে ৪০০’র বেশি চ্যানেলে প্রিমিয়ার লিগের খেলা সম্প্রচার করা হয়। এই বছর বিদেশি সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ ঘরোয়া চুক্তি থেকে পাওয়া অঙ্কটাকে ছাড়িয়ে গেছে আর এমনটি এই প্রথম হলেও সামনে যে একই ট্রেন্ড চালু থাকবে তাই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। আগামী তিন বছরের সকল চুক্তি ঠিক মত সম্পন্ন হলে প্রিমিয়ার লিগ এইসময়ে বিদেশি সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে ৫.৩ বিলিয়ন পাউন্ড এবং ইউকের মধ্যকার সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে ৫.১ বিলিয়ন পাউন্ড আয় করবে বলে ধারণা করা হয়।
প্রিমিয়ার লিগ চালুর পর থেকে ৫০ টিরও বেশি ক্লাব এতে বিভিন্ন সময় অংশ গ্রহণ করেছে কিন্ত বরাবরই ইংল্যান্ডের বড় শহরের ক্লাবগুলো এখানে নিজেদের আধিপত্য দেখিয়ে আসছে। লন্ডন, লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টার এই তিন শহর থেকে উঠে আসা ক্লাবগুলোতে প্রিমিয়ার লিগ ছয়লাব এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে এমনটা ভাবার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
৩০ বছর ধরে সফলতার সাথে চলে আসা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আগামী বছরগুলোতেও সফলতার সাথে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে যাবে এমনটাই সকলের কামনা। তবে সাবেক আর্সেনাল ম্যানেজার আর্সেন উয়েঙ্গার মনে করেন তিন দশক আগে প্রিমিয়ার লিগ যেভাবে গঠিত হয়েছিল আবারো এমন কিছু হলে সব হিসাব পালটে যাবে। তার ইঙ্গিতটা যে গত বছর শুরুর ঘোষণা দিয়েও শেষমেশ বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের ইউরোপিয়ান সুপার লিগের দিকে তা খুব সহজেই বোঝা যায়।
বর্তমানে ফিফার চিফ অফ গ্লোবাল ফুটবল ডেভেলপমেন্টের দায়িত্ব পালন করা ওয়েঙ্গার বলেন, ‘সুপার লিগই একমাত্র হুমকি, আমি অবাক হয়েছিলাম যে ছয়টি ইংলিশ ক্লাব এতে যোগদান করেছিল। হয়তো তারা একটা লিগকে আমেরিকায় সরিয়ে নিবে। তবে সেখান থেকেও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে তারা, আমেরিকা যদি কখনো ফুটবলে শক্তিশালী হয় তাহলে তা তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াবে।’
প্রিমিয়ার লিগের মত আর কোন ‘ব্রেক অ্যাওয়ে লিগ’ ভবিষ্যতে দেখা যাক বা না যাক, প্রিমিয়ার লিগ এবং তার ফুটবল উৎসব বেচে থাকুক আরো শত শত বছর এটাই ফুটবল ভক্তদের কামনা।