‘মেয়েরাও আবার ক্রিকেট খেলে? তুমি কি পড়াশোনা টোনা কিছু করো?’
গল্পটা সেই সময়কার যখন ভারতবর্ষে মেয়েদের ক্রিকেট জনপ্রিয় ছিল না। জনপ্রিয়তা তো দূরে থাক পাড়ার একটি মেয়ে ক্রিকেট খেলবে এই বিষয়টিই স্বাভাবিক ছিল না। আর এমন অনেক কটু কথা শুনেই বড় হয়েছেন ভারতীয় নারী ক্রিকেটের অগ্রদূত ঝুলন গোস্বামী।
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাকদাহ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক। টিভিতে ১৯৯২ বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখার পর তাঁর ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠে। তারপর তিনি তাঁর আশেপাশের ছেলেদের সাথে খেলাটি খেলতে শুরু করেন। তাঁর সমবয়সী মেয়েরা ক্রিকেট খেলা তো দূরে থাক, খেলাই বুঝতো না। যে সময়ে ঝুলন একজন ক্রিকেটার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন নারীদের পক্ষে ক্রিকেট খেলার কথা ভাবাও একটা কঠিন কাজ ছিল।
ছোট শহরের একটি মেয়ে ঝুলনের বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটার ‘ঝুলন গোস্বামী’ হয়ে ওঠার গল্পটা সহজ নয়। চাকদহে টিনের ছাদের ছোট্ট একটি দুই কক্ষের বাড়িতে তিনি দুই ভাইবোন এবং বাবা–মায়ের সাথে থাকতেন। যেখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ঐতিহ্যগতভাবে নাচ এবং গান চর্চা করাটাই মানানসই ছিল, ঝুলন সেখানে পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলাতে আগ্রহী ছিলেন। যদিও ঝুলনকে দলে নিতে তাঁরা আগ্রহী ছিল না।
ঝুলন একবার বলেন, ‘তারা আমাকে বল করতে দিতে চাইতো না, বলত তোমার বল স্লো। এভাবেই আমি দ্রুত বল করার তাগিদ গড়ে তুলেছি।’ সেই ঝুলনই পরবর্তীতে ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় বোলিং করে মাঠে আগুন ঝড়িয়ে দিতেন। তিনি নারীদের মধ্যে বিশ্বের দ্রুততম ছিলেন।
ছোট শহরে পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুবিধা না থাকায়, ঝুলন তাঁর বাবা–মাকে রাজি করান তাকে দক্ষিণ কলকাতার বিবেকানন্দ পার্কের একটি কোচিং সেন্টারে যেতে দিতে। যদিও এই পথটুকু বেশ বন্ধুর ছিল তাঁর জন্য। তাঁর আত্মীয় স্বজনরা এই সিদ্বান্তের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু দাদীর সমর্থন থাকায় ঝুলন শেষমেশ একাডেমীতে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই অনুশীলন সেশনের জন্য প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘন্টা লোকাল ট্রেনে ভ্রমণ করতে হতো তাঁকে। এবং এই ক্রিকেট ও যাতায়াতের কারণে ঝুলনের পড়াশোনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।
ঝুলন তাঁর প্রথম প্রশিক্ষক স্বপন সাধুর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। ঝুলনকে অনুশীলনে পাঠাতে তাঁর পরিবারকে রাজি করানোর পেছনে তিনি দারুণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কলকাতায় প্রশিক্ষণ শেষ করার পর, ঝুলন বেঙ্গল নারী ক্রিকেট দলে যোগ দেন।
২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় উনিশ বছর বয়সে। তাঁরপর থেকে বিশ্ব ক্রিকেট অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছে ঝুলনের দারুণ বোলিং প্রতিভাকে। নারী ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম বোলারদের একজন হয়ে উঠেছেন সেদিনের বলে গতি নেই বলে ছেলেদের সাথে দলে জায়গা না পাওয়া সেই মেয়েটি।
২০১২ সালে মর্যাদাপূর্ণ পদ্মশ্রীতেও ভূষিত হয়েছেন ঝুলন গোস্বামী। ২০১৬ সালে, তিনি আইসিসি নারী একদিনের আন্তর্জাতিকে বোলিংয়ে র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। বিশ্বের প্রথম নারী ক্রিকেটার হয়ে ২০০ উইকেটের মাইলফলক তৈরী করে, ভারতকে ক্রিকেট ইতিহাসে দারুণ সম্মান এনে দিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটাঙ্গনে ঝুলন গোস্বামী অনেক অনেক ক্রিকেট অনুরাগী অনুজের জন্য অগ্রদূত হয়ে রইবেন।