বিশ্ব মঞ্চে বিবর্ণ কেন ভারত!

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) যে কোনো টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফেভারিটের তালিকায় ভারতের নাম উপরের দিকেই থাকে। যে কোন ফরম্যাটই হোক কিংবা বিশ্বের যে প্রান্তে খেলা হোক- ভারতকে শিরোপার বড় দাবিদার মনে করা হয়। আর এমন ভাবনা যথেষ্ট যৌক্তিক বটে, কেননা তিন ফরম্যাটের র‍্যাংকিংয়ে ভারতের অবস্থান সেরা পাঁচে। কিন্তু কেন যেন আইসিসির টুর্নামেন্টে প্রত্যাশামাফিক ফলাফল পাচ্ছে না ভারত।

২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু ভারতের ব্যর্থতার পথচলা; সেবার ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেছিল তাঁরা। এরপর ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে হার, ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরাজয়, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে হেরে রানার আপ, ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারার পর ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া।

সব টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ‘হট ফেভারিট’ থাকলেও সর্বশেষ ছয়টি বিশ্বকাপ আসরে শিরোপা জিততে পারেনি ভারত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে কেন আইসিসির টুর্নামেন্টে বারবার খেই হারায় ভারত, সেটির সম্ভাব্য উত্তর এবার খুঁজে বের করা যাক।

  • ভারত – যথেষ্ট সাহসী নয়

আধুনিক ক্রিকেটের এই সময়ে আক্রমণাত্মক ভাবে খেলাটাই বোধহয় জয়ের সেরা মন্ত্র। কিন্তু প্রতিভায় পরিপূর্ণ ভারতীয় দলে সেই সাহসী মনোভাব খুব একটা দেখা যায় না। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইন বলেন, “আপনাকে মাঠে পুরোপুরি প্রকাশ করতে হবে। তাদের (ভারতের) প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের কোন অভাব নেই কিন্তু তাঁরা ভয়হীন ক্রিকেট খেলতে পারছে না।”

আর এই রক্ষণশীল স্টাইলের খেলার পেছনের বড় একটি কারণ ভক্ত-সমর্থকদের উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশা। ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমর্থকগোষ্ঠী ভারতের, আর তাদের কাছে এই ক্রিকেট রীতিমতো ধর্মের মত। শুধুমাত্র শিরোপা জিততে পারা এই দর্শকদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারে। অতীতে দলের ব্যর্থতায় ভক্তদের অনেককে সহিংস কার্যক্রমে জড়াতে দেখা গিয়েছে।

এই যেমন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভারত হেরে যাওয়ার ফলে গ্যালারিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল দর্শকদের একাংশ। একই ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরেও; বীরেন্দ্র শেবাগ, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রাহুল দ্রাবিড়ের মত কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের বাড়িতেও হামলা করে উগ্র সমর্থকরা।

এছাড়া জাতীয় দলে নিজের জায়গা ধরে রাখার জন্য অনেক ক্রিকেটারই ঝুঁকি নিতে ভয় পান। ভারতে এখন খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতা অনেক বেশি, তাই ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে না পারলে দলে জায়গা হারানো সময়ের ব্যাপার। ফলে প্রায় সব ক্রিকেটার চায় দলে নিজের জায়গা ধরে রাখতে, এজন্য ঝুঁকিহীন ক্রিকেট খেলার পথ বেছে নেয়।

  • অধিক ম্যাচ খেলার ক্লান্তি

২০১৩ সালে অর্থাৎ সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের বছরে ভারতীয় ক্রিকেটাররা ৩১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলেছিল। অথচ ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ২৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পাশাপাশি লম্বা সময় ধরে আইপিএল খেলেছে। এই আইপিএল শেষ হয়েছিল বিশ্বকাপের মাত্র দুইদিন আগে, ফলে খেলোয়াড়দের মাঝে ক্লান্তি আর অবসাদ দেখা দিয়েছে যা বিশ্বকাপের ম্যাচেও প্রভাব রেখেছে।

তাছাড়া এই সময় ক্রিকেটারদের টানা জৈব সুরক্ষা বলয়ের মাঝে থাকায় তাদের মানসিকতা অনেকটাই নেতিবাচক হয়ে পড়েছিল। এই ব্যাপারে ভারতের সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রী বলেন, “আমাদের মাঝে সাহসের অভাব ছিল এবং এটির কারণ মানসিক অবসাদ। ছেলেরা কতটা সময় বাবলে কাটিয়েছে সেটা লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে; ম্যাচ নির্ধারণী মুহুর্তগুলোতে জ্বলে উঠতে হয়, এক্স-ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তেমন কিছু ঘটেনি।”

এসব সমস্যা মিলিতভাবে ভারতকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; আইসিসির টুর্নামেন্ট জয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনেই আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, নতুন কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে এবার অন্তত ভিন্ন কোন দৃশ্য দেখতে চাইবে টিম ইন্ডিয়া। আর সেটা যে শিরোপা হাতে উদযাপনের দৃশ্য, তা বোধহয় আলাদা করে না বললেও চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link