চোটের কারণে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে জাসপ্রিত বুমরাহর ছিটকে যাওয়ার খবরে ক্রিকেট জগতে, বিশেষত ভারতীয়দের মধ্যে একই সঙ্গে কৌতূহল ও প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, যেটা খুব স্বাভাবিক। বেশিরভাগেরই বক্তব্য এত বিশ্রাম দিয়ে দিয়ে অর্থাৎ রোটেশন পদ্ধতিতে খেলানোর পরেও গোটা বছর ধরে মাত্র পাঁচটা করে টেস্ট, ওয়ানডে আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে কিভাবে একজন পেসার এত গুরুত্বপূর্ণ একটা টুর্নামেন্ট থেকে সেই চোটের কারণেই ছিটকে যান?
আরও মারাত্মক অভিযোগ উঠছে যে, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চলার আগে বা চলাকালীন এঁরা কেন কোনো চোট পান না? যাবতীয় চোট আসে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগেই। এত উন্নত ব্যবস্থা, দক্ষ ফিজিও আর এনসিএ তে ট্রেনিং এর পরও? উদাহরণ দেওয়া চলছে বিভিন্ন কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের, তাঁদের সাফল্য ও ওয়ার্ক লোডের তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরে। আংশিক হলেও যুক্তি আছে সে সবের পেছনে, এটা অনস্বীকার্য।
অভিযোগ গুলো আবেগতাড়িত হয়ে করা বা বিসিসিআইয়ের এই ব্যাপারে জবাবদিহি করা উচিত কিনা, সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের আবেগ ও ক্ষোভের কারনকে উপযুক্ত সম্মান জানিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বুমরাহর চোট অত্যাধিক ক্রিকেটের ক্লান্তিজনিত কারনে নয়, বরং অ্যাকশনজনিত সমস্যার জন্য। যাঁরা জাডেজা আর বুমরাহের চোটকে একই বন্ধনীতে রাখছেন, তাঁদের অবগতির জন্য বিনীত নিবেদন, বহুদিন আগেই মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং মাত্র কয়েকদিন আগেই শোয়েব আখতার মন্তব্য করেন বুমরাহকে বেছে বেছে খেলানোর সুপারিশ করে।
শোয়েব তো একধাপ এগিয়ে টেস্টের পরিবর্তে সীমিত ওভারের ম্যাচেই বুমরাহকে খেলিয়ে যেতে বলেছিলেন। তাঁর স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না হলে এক বছরের মধ্যেই বুমরাহ ভেঙে পড়তে পারেন। নিজের সময়ে বিশ্বের দ্রুততম বোলার ব্যক্তিগত জীবনে চোট আঘাতপ্রবণ থাকায় কিছু ব্যাপার হয়ত আমাদের থেকে ভালো অনুমান করতে পেরেছিলেন।
আইপিএল খেলে উত্থান হলেও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বিশেষ করে আইসিসি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মিস করবার অর্থ বুমরাহর মত বুদ্ধিমান বোলার বুঝবেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর বিচিত্র অ্যাকশনের জন্য যে পিঠের পেশি আর তার নীচে থাকা হাড়ে প্রবল চাপ আসে, সেটা যে কোনো অস্থি বিশেষজ্ঞ খালি চোখে দেখেই বলবেন।
লক্ষ্য করে দেখবেন, ২০১৩-২০১৬ আইপিএল এবং ২০১৬ তে অস্ট্রেলিয়াতে টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে তে অভিষেক হওয়ার সময় থেকে ২০১৮ তে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট অভিষেক হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে বুমরাহ ছিলেন এমন একজন মিডিয়াম পেসার, যিনি কখনো সখনো ১৩৫+ স্পিডে বল করতেন, হাতে ভাল ইয়র্কার ছিল আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, তখন তাঁর রান আপ এখনকার মত এত ছোট ছিল না।
টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে মোটামুটি ভালোই করার বছর দেড়েক পর বুমরাহ সফল টেস্ট অভিষেক ঘটান এবং অল্পদিনের মধ্যেই অনুভব করেন বিরাট কোহলির আগ্রাসী অধিনায়কত্বে বিদ্যুৎগতির টেস্ট পেস ব্রিগেডের অংশ হতে হলে তাঁকে মিডিয়াম পেস বোলিং ছেড়ে প্রকৃত ফাস্ট বোলার হয়ে উঠতেই হবে। হাতে দারুণ কার্যকরী ইয়র্কার থাকায় আর ব্যাটারকে বিভ্রান্ত করার উপযোগী অ্যাকশন হওয়ার জন্য ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টও দ্রুতই অনুভব করে টেস্ট দলে বুমরাহর মত পেসার থাকার গুরুত্ব।
ভূবনেশ্বর তখন চোটজনিত কারনে পেস হারিয়ে ফেলায় টেস্ট খেলতে আর উৎসাহ দেখাচ্ছিলেন না। তাঁর অপসারণের পর ইশান্ত, শামি, উমেশের পাশাপাশি কোহলির দরকার ছিল বিদেশে টেস্ট সিরিজ় জেতার জন্য চতুর্মুখী পেস ব্যাটারির একজন উপযুক্ত চতুর্থ সদস্য। বুমরাহ আসাতে সেই পেস আক্রমণ পূর্ণতা পেল। রানআপ কমিয়ে, ১৪০+ বা বলা ভাল সময়ে সময়ে ১৪৫ কিমি গতির তাঁর পেসের ছোবলে ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দল, তাদের নিজেদের মাটিতেই। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বাইরে তাঁকে নিয়ে চিন্তা করলে প্রথমদিকে যেসব বিশেষজ্ঞ নাক কুঁচকোতেন, দায়িত্ব নিয়েই টেস্ট বোলার হিসেবে বুমরাহ কিন্তু খুব অল্পদিনেই তাঁদের সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন।
৭২ ওয়ানডে তে ২৪.৩ গড়ে ১২১ আর ৬০টি টি-টোয়েন্টিতে ৬.৬২ এর দুর্ধর্ষ ইকোনমি রেটে ৭০টি উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ৩০ টেস্টে ২১.৯৯ গড়ে একটি হ্যাট্রিক ও ইনিংসে ৮ বার পাঁচ উইকেটসহ ১২৮টি উইকেট নেওয়ার ঈর্ষনীয় টেস্ট রেকর্ড বুমরাহের। এর সাথেই খেলেছেন আইপিএলে, ১২০ টি ম্যাচে ৭.৩৯ এর ইকোনমি রেটে নিয়েছেন ১৪৫ উইকেট। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাপ জেতার স্বপ্নের দৌড়ে একাধিকবার সামিল হয়েছে তাঁর অবদানের সাক্ষর। প্রথম শ্রেণীর বা রঞ্জি ট্রফির ম্যাচগুলোর আলোচনা আর এখানে করলাম না। যদিও জানা সেখানেও লেখা আছে তাঁর স্বেদসিক্ত পরিশ্রমের অসংখ্য নীরব উপাখ্যান।
আলোচনায় ফিরি। রানআপ কমিয়ে একই অ্যাকশনে পেস বাড়াবার অর্থ পিঠ-ঘাড়-হাতের পেশীতে ও হাড়ে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া। তার উপর বুমরাহের অ্যাকশন পুরোপুরি আনঅর্থোডক্স। এতে তাঁর কোমরের হাড়েও মাত্রাতিরিক্ত চাপ আসে, উপরের স্তর ভেঙে ফ্যাসেট জয়েন্টের মধ্যেকার হার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নীট ফল কোমরে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠার সময় সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতার কারণে বুমরাহ শরীরে ভিটামিন- ডি আর ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ছিল। তাঁর বোলিং অ্যাকশন আর ইয়র্কার স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের সম্ভাবনাকে দিনে দিনে শুধু বাড়িয়ে তুলছিল এই যা।
মাইকেল হোল্ডিংয়ের মত সাবেক ক্রিকেটাররা যেমন মনেই করছেন, এইরকম খাপছাড়া বোলিং অ্যাকশনধর্মী বোলারদের চোট আসাটা খুব স্বাভাবিক, বিশেষত: পেসারদের (যেমন, পাকিস্তানের সাবেক পেসার সোহেল তানভির, শ্রীলঙ্কার পেস কিংবদন্তি লাসিথ মালিঙ্গা)। বিজ্ঞানের বা এয়োরোডায়নামিক্সের পরিভাষায় বললে হাইপারমোবিলিটির বিচারে বুমরাহের অ্যাকশন গ্রেড ২ হাইপারএক্সটেন্ডেড। বুমরাহের বল রিলিজ় পেস, সিম পজিশন আর ১০০০ আরপিএম এর রোটেশনাল স্পিড যে ডেলিভারি স্পিন রেশিও উৎপন্ন করে, তাঁর পরিমাপ ০.১। এটা ডেলিভারিকে একটা রিভার্স ম্যাগনাস এফেক্ট দেয়।
ইয়র্কার লেংথে পড়া বুমরাহের যেকোন ডেলিভারি তার এই ডাউনওয়ার্ড ফোর্সের কারনে যে তীক্ষ্ণ কোণ তৈরী করে, তাতেই ব্যাটার বিভ্রান্ত হন বা ক্রিজের উপর পড়ে যান (সদ্যসমাপ্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজে স্টিভন স্মিথ যার টাটকা উদাহরণ) বা বলা ভাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আউট হন (ঐ একই সিরিজ়ে অ্যারন ফিঞ্চ)। কাজেই পুরোটা পড়ার পর বুমরাহকে ‘আইপিএলের বাহানায় বিশ্বকাপ মিস করার বান্দা’ এটা মনে করে যাঁরা ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন, তাঁরা একবার ভেবে দেখবেন গত সাত বছর যাবৎ সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে কখনও আধা ফিট ইশান্ত, কখনও পারিবারিক ঝঞ্ঝাটে বিপর্যস্ত শামি, কখনও অনভিজ্ঞ সিরাজ-নটরাজন, কখনও বিভ্রান্ত উমেশকে সঙ্গী করে এই ছেলেটি কি সাংঘাতিক সাফল্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত অবদানের পাশাপাশিই গোটা ভারতীয় পেস অ্যাটাকের নেতৃত্ব দিয়েছে।
প্রয়োজনে সীমিত ক্ষমতায় ব্যাট হাতেও প্রাণপনে লড়েছে। ২০১৮-২০১৯ আর ২০২০-২০২১ এর পরপর দুবার অস্ট্রেলিয়া বিজয় এবং ২০২২ এ হওয়া শেষ টেস্ট বাদ দিলে ২০২১ এর ইংল্যান্ড সফরে ভারতের ২-১ এ এগিয়ে যাওয়া সেটা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছে। সঙ্গে থাকল ২০১৯ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজে জয়, দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত সিরিজগুলি এবং অবশ্যই অসংখ্য ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ দেশে বিদেশে ভারতের জয়ী হওয়ার পরিসংখ্যানগুলি।
প্রশ্নটা বরং করা উচিৎ সৌরভ গাঙ্গুলি-জয় শাহের নেতৃত্বাধীন সর্বশক্তিমান বিসিসিআইকে, যাঁরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হবেন না আইপিএল নামক আপাত সোনার ডিমপাড়া হাঁস, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই ভবিষ্যতে ফ্র্যানকেনস্টাইন হয়ে উঠতে চলা ক্রোড়পতি লীগের লোভে। প্রশ্ন করা উচিত তাঁদের প্রায়োরিটি, কমিটমেন্ট আর ফিজিও-রিহ্যাবিলিটেশনের পেছনে প্রত্যাশিত ফলের কাছাকাছি না পৌঁছানো সত্ত্বেও বিপুল ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে। আর সর্বোপরি আইপিএল এর ফ্র্যান্চাইজিদের নিয়ন্ত্রণ করার নীতি নিয়ে। আজ আইপিএল এর দেখাদেখি বিভিন্ন বোর্ড ঘরোয়া লীগের আয়োজন করে থাকে।
এবং প্রয়োজনে ‘গুরুত্বহীন’ বা ‘অকিঞ্চিৎকর’ আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলে অনেক ক্রিকেটার সেখানে খেলাই উচিত বিবেচনা করছেন (অতি সম্প্রতি সাকিব অল হাসান ক্যারিবিয়ান লিগে খেললেন, যেখানে তাঁর জাতীয় দল বাংলাদেশ তখন আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে টি টোয়েন্টি সিরিজ খেলছিল)। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারদের বোর্ডগুলোও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
অনেক অবসরপ্রাপ্ত বা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আঙিনায় দেখার সম্ভাবনা কম যাঁদের, সেইসব ক্রিকেটারদের আর্থিক নিরাপত্তার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ বা সে সবক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল হওয়ার দরকার থাকলেও আইসিসির এবার সময় এসেছে ম্যাচ গড়াপেটা অধ্যায়ের পর আরেকবার কড়া হাতে বিশ্বজুড়ে চলা টি -টোয়েন্টি লীগগুলো যথাযথ নিয়ন্ত্রণ বা প্রয়োজন হলে বন্ধ করার, বিশেষ করে আইপিএলের ব্যাপারে কড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
আইপিএলের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে সময় বের করাটা আইসিসির অপদার্থতা ও ক্লীবত্বের পরিচয় তো বটেই, তাছাড়াও অর্থের জন্য কাপুরুষের মত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিসিসিআই এর দেখাদেখি অদূর ভবিষ্যতে বাকি বোর্ডগুলোও একই দাবী তুললে আইসিসি কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ক্যালেন্ডার ব্যাপারটা তুলেই দেবে? নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিণত হবে ফুটবলের বিশ্বকাপ বা ইউরো বা কোপা আমেরিকার মত দ্বিবার্ষিক বা চতুর্বার্ষিক টুর্নামেন্টের ক্ষণস্থায়ী রৌশনিয়ে, যা অনেকদিন পর পর একবার জ্বলেই নিভে যাবে। আর তার নির্বাপণ নিশ্চিত করবে গোটা বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলতেই থাকা বিভিন্ন লীগগুলোর চাকচিক্যভরা টি- টোয়েন্টির মশালার ভান্ডার।
দুর্ভাগ্য এটাই, তখন ক্রিকেট আর ক্রিকেট থাকবে না আর। না থাকবে আমাদের মত সাধারণ ক্রিকেট প্রেমীদের খেলার প্রতি সেই আকুতি, আর না বুমরাহের মত ক্ষণজন্মা কোন জিনিয়াসের প্রতি দুর্বলতার রেশটুকুও। কর্পোরেট কালচারের প্রেশার ভিক্ষা দেবে অনেক টাকা, সম্পত্তি, তাঁবেদার, ক্ষমতা….বিনিময়ে কেড়ে নেবে সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ, ক্রীড়ামোদীদের অনায়াস সারল্য, ক্রিকেটের চিরকালীন রোমান্টিসিজম ভরা সেই ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা’কে।
হলিউডি সিনেমার সেই কঠোর, কিন্তু বীভৎস নগ্ন সত্যের সংলাপটা আবার একবার মনে পড়ে গেল – ‘দেয়ার ইজ নো সাচ নিউজ, দ্যান ব্যাড নিউজ ডিয়ার।’