পরজীবী নয়, হেডলাইন হয়ে বাঁচব

বলা হয়, রাজপুতরা নাকি হেরে যায় না। লড়তে হবে, লড়াই করতে হবে যতদিন বেঁচে আছি – কথাগুলো বলতেন বাবা অনিরুধ জাদেজা। যদিও সামান্য ওয়াচম্যানের মুখে এত বড় দার্শনিক বাণী শুনেও সেভাবে পাত্তা দিত না কেউ।

শুধু ছোটো ছেলেটা শুনত, মন দিয়ে শুনত। মা সরকারি হাসপাতালে নার্স হবার সুবাদে একটা ছোট্ট এককামড়ার সরকারী কুঠুরি জুটেছিল চারজনের সংসার গুছিয়ে নেবার। সময়টা ১৯৯৮-৯৯ সাল, গোঁড়া গুজরাটি রাজপুত পরিবারের বউ সরকারী চাকরি করলে তা ছিল পড়শির চর্চার বিষয়, কিন্তু অনিরুধের সামান্য ঠিকা চাকরিতে দুই ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ সম্ভব না! অগত্যা!

২০০৫ সালে নেমে এল সেই অন্ধকারতম দিন, দুর্ঘটনায় এক নিমেষে শেষ হয়ে গেলেন লতা জাদেজা, ১৭ বছরের রবীন্দ্র জাদেজার একমাত্র অবলম্বন, তার খেলার সাথী, তার বন্ধু, তার পরিবারের অবলম্বন! একটা দুর্ঘটনায় ভেঙে চুরমার করে দিল ১৭ বছর বয়সে ক্রিকেটের তালিম নিতে শুরু করা একটা ছোট্ট ছেলের জীবন।

কিন্তু রবীন্দ্র জাদেজার পিছনে ফিরে তাকানোর ফুরসত ছিল না আর, লড়াই অসমাপ্ত রেখে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে দেওয়া মানে ক্ষত্রিয়ের অসম্মান, বাবার দেওয়া বীজমন্ত্র নিয়েই ক্রিকেটের বাইশগজের সমস্ত লড়াই-এর জন্যে নিজেকে তৈরী করলেন রভি। তার বন্ধু হয়ে উঠল দিদি, মায়ের ফেলে যাওয়া নার্সের চাকরি, অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ যে তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে, রবীন্দ্রর সামনে খুলে দিয়েছিল মুক্ত ক্রিকেটের সবুজ গালিচা।

রবীন্দ্রর কোচ ছিলেন গুজরাটের চৌহান স্যার, এক সাক্ষাতকারে আজকের স্টার স্যার জাড্ডু বলছিলেন, ‘একদিন চৌহান স্যার আমাকে পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে থাপ্পড় মেরেছিলেন, মা চলে যাবার ভেতরের যন্ত্রণা থেকেই চোখে জল এসেছিল থাপ্পড়ের পর, আজ বুঝতে পারি আমাকে কতটা দৃঢ় করে দিয়েছিল ঐ থাপ্পড়টা!’

১০ বছর বয়স থেকে পাড়া ক্রিকেট, ক্যাম্প কোথাও রবীন্দ্রকে ব্যাট করার সুযোগ দিত না কেউ, মায়ের কাছে এসে রাতে কেঁদে ফেলত যে ছেলেটা একদিন সেই দেখল রাতে ফিরে কাঁদলেও মা আর মাথায় হাত রাখছে না – সেইদিন, ঠিক সেইদিন জন্ম হয়েছিল একজন গ্ল্যাডিয়েটরের, ক্রিকেটের রান-উইকেটের বাইরে একজন যোদ্ধার যে ভেঙে পড়াকে পাপ মনে করে!

সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জিতে চান্স পেতে হতে হয়েছিল ফাস্ট বোলার, ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে তিনটে ট্রিপল সেঞ্চুরি পকেটস্থ করল সেই ছেলেটাই- যোদ্ধা ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে?

অনেকে বলেন তিনি এমএস ধোনির কোটার প্লেয়ার, অথচ কেউ বলে না ভারতীয় ক্রিকেটের উদ্দাম নৈশপার্টির জৌলুস,হাজার হাজার ক্রিকেট বুকির প্রলোভনের পরেও নিজেকে দেশের জন্য বিলিয়ে দিতে পেরেছেন এই ধোনি-কোটার ছেলেটাই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাড়ে চার হাজার রান ওপর রান সাথে সাড়ে চারশর ওপর উইকেট, আইসিসি একদিনের বোলার র‍্যাংকিং-এ অনিল কুম্বলের পর ২০ বছর বাদে শীর্ষে পৌঁছেছেন এই ছেলেটাই, ১৭ বছরে মায়ের মৃত্যুর পর অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে সকলের নজর কেড়ে নেওয়া থেকে ২০১৯-সেমিফাইনালে ভারতের নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচ একা হাতে প্রায় ঘুরিয়ে দেওয়া খেলোয়াড়টার নামই রবীন্দ্র জাদেজা!

ক্রিকেট ছাড়া ঘোড়সওয়ারি আর লাঠিখেলাই নেশা রবীন্দ্রর, তার নিজস্ব পৃথিবীতে এখনো তার আইকন তার বাবা৷ সামান্য ওয়াচম্যানের চাকরি করা বাবা অনিরুধ যে জন্মের পরেই রবীন্দ্রর কানে গেঁথে দিয়েছিল প্রাণমন্ত্র – ‘জীবনে হাল ছাড়তে নেই, আমরা রাজপুত, লড়াই আমাদের রক্তে, শেষ রক্ত যতক্ষণ আছে লড়ে যাস!’

প্রতিটা সেলিব্রেশন প্রমাণ করে তিনি রংমশাল নয়, বহুযুদ্ধের নায়ক রভি চিরন্তন জ্যোতস্না হতে চেয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে, তার নিজস্ব মহল্লায় তিনিই সম্রাট, আর কেউ নেই!

হর্ষ ভোগলে বলেছিলেন ভারতে ক্রিকেট প্রতিভা নিয়ে অনেকেই আসে কিন্তু এমন মানসিক দৃঢ়তা সচরাচর দেখা যায় না। যেন সেই চেনা প্রবাদ, জীবনে যাই হয়ে যাক,দেশের জন্য লড়াইতে নিজেকে বলিদান দিয়ে যেতে হবে। তাই পরজীবী নয়, যতদিন বাঁচব হেডলাইনে বাঁচব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link