এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে বা সময়ই কখনও একবার বলেছিলাম যে লিওনেল স্কালোনি খুব বুদ্ধি করে সীমিত সামর্থের দলকে খেলাচ্ছেন। লে সোলসোর না থাকাটা একটা বড় চাপ হয়ে গিয়েছিল। এবং বার বার করে একজনের নাম করে গেছি সেটা হল এঞ্জো ফার্নান্ডেজ। এঞ্জো ফার্নান্ডেজ ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ং-এর মত দৃষ্টিনন্দন নন, কিন্তু প্রায় সমমানের কার্যকরী ফুটবল খেলে যাচ্ছিলেন এবছর বেনফিকায়।
সে যাক, আর্জেন্টিনা দলটায় আবার ফিরে আসি। এটা খুব ভাল করে জানতাম যে স্কালোনি রোমেরোকে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে ইউরোপীয়দের সঙ্গে খেলার সময় অবশ্যই খেলাবেন। দুজন কম উচ্চতার স্টপার ব্যাককে একসঙ্গে খেলাবার ঝুঁকি নেবেন না। মেক্সিকোর অবশ্য অন্য কথা।
এবারের বিশ্বকাপে পটেনশিয়ালই মাঝারি দলগুলোকে দেখে বেশ অবাক হয়েছি। ডেনমার্ক, সার্বিয়া বা সুইজারল্যান্ড। এরা ডিফেন্সিভলি খুব ভাল, সংগঠন জোরালো রাখে, সুযোগে প্রেস করে বা প্রতিআক্রমণ থেকে গোল তুলে নেয়। কিন্তু এবারে দেখলাম বড় দলের বিরুদ্ধে তারা যেন হারার আগেই হেরে বসে আছে। গোল করার ইচ্ছা নেই, জেতার ইচ্ছা নেই। আর্জেন্টিনা গাড্ডায় ছিল বটে কিন্তু মেক্সিকো বা পোল্যান্ডের কোনও তাগিদ দেখা গেল না তার ফায়দা ওঠাবার। সে যা হোকগে।
স্ক্যালোনি আমার মনে হয় লে সোলসো না থাকা অবস্থায় কাল যে দলটি নামিয়েছিলেন সেটাই ওঁর দল। এই দলটাই স্কালোনির টেমপ্লেটে খেলে, খেলবে। দুই স্টপার ওটামেন্ডি আর ডানদিকে কোরিয়া। বক্স টু বক্স এঞ্জো ফার্নান্ডেজ, দুদিকে ওভারল্যাপিং দুই সাইড ব্যাক আকুনা আর মোলিনা।
মাঝমাঠে মেসির শ্যাডো ডি পল, মেসি যখন ফুল ফোটাবেন তখন তিনি ধুলো ময়লা সাফ করবেন। ডানদিকে উইং-এ দি মারিয়া। বাঁ দিকে লে সোলসোর জায়গাটায় ম্যাক অ্যালিস্টার আর উপরে ভাজা মাছটাই একমাত্র উল্টে খেতে জানা লাউতারো মার্তিনেজের জায়গায় এবারে ম্যান সিটিতে হল্যান্ডের বদলি হিসাবে চমকে দেওয়া হুলিয়েন আলভারেজ।
এবারে পোল্যান্ডের বিষয়ে সামান্য কিছু শব্দ। ওই যে টেমপ্লেটটার কথা বলছিলাম যে আঁটোসাঁটো ডিফেন্স দরকার প্রতি আক্রমণে উঠে কিছু একটা করা। এটা পোল্যান্ড সৌদির সঙ্গে করেছে। সৌদি? হ্যাঁ, সৌদি আরবকেই যে দলটা এত সমীহ করছে, সে আর্জেন্টিনার মত হেভিওয়েটের বিরুদ্ধে কী করবে বলুন!
ওদের কোচ নাকি আগের দিন টিম মিটিং-এ বলেছেন খেলোয়াড়দের যে, যদি গোল খাও তাহলেও ঘাবড়াবে না প্যানিক করবে না। না প্যানিক করেনি পোল্যান্ড, কিছুই করেনি। যেমন চলছিল তেমনই রেখে বেরিয়ে গেল। কপাল ভাল সৌদিরা অভিজ্ঞতার অভাবে প্রথম গোলটা আর একটা অসাধারণ ফ্রি কিকে দ্বিতীয় গোলটা খেয়ে গেছিল।
সে যাক, ৪-৪-২ যেটা দ্বিতীয়ার্ধে আরও ডিফেন্সিভ ৪-৫-১ হয়ে গিয়েছিল। পোল্যান্ডের ইচ্ছা ছিল সেন্টার সার্কেলের আশপাশটা দখল করে আর্জেন্টিনার খেলার গতি রুদ্ধ করবে। তা সেরকম শুরু করেছিল বটে। প্রথমার্ধে যথেষ্ট গতিতে শুরু করেও দাঁত ফোটাতে পারছিলেন না মেসিরা। পেনাল্টিটা নিয়ে নিউজরিল খরচ করে সত্যিই কাজ নেই। ভিএআর ফ্ললেস পারফরম্যান্স দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রেফারিরা? সে থাক।
দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা তিন ব্যাক সিস্টেমে চলে গেল যেখানে মাঝখানে এঞ্জো ফার্নান্ডেজকে পিভট রেখে দু দিকে ওটামেন্ডি আর রোমেরো। ওটামেন্ডি অনেকটা বেশি কনজারভেটিভ কারণ ওদিকে আকুনা আছে। আর প্রথমার্ধ থেকেই ইনসাইড লেফটের জায়গাটায় ম্যাকঅ্যালিস্টার খেলছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে তিনি জুলিয়েন আলভারেজের সঙ্গে জায়গা বদল করে খেলতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যেই জুলিয়েন বাঁ দিকে উইং-এ চলে যাচ্ছিলেন, আর ম্যাকঅ্যালিস্টার একটা কোনাকুনি রানে স্ট্রাইকিং পজিশনে।
এবারে ডানদিক। ডানদিকে ডি পল সেন্টার সার্কেলের উপরের জায়গাটা ধরে নিয়েছিলেন, মেসি খেলা তৈরির জন্য তখন নিচে নামছেন। ডি মারিয়া একটু উপরে টাচ লাইনের ধার ঘেঁসে। মলিনা নিচ থেকে উঠছেন, এই মলিনা- ডি মারিয়া আর দি পলের একটা ত্রিভুজ তৈরি হচ্ছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে রোমেরো অনেকটা উঠে মেসিকে বল বাড়াতে শুরু করলেন ডি পল আরও উঠে গেলেন পোল্যান্ডের লেফট ব্যাক আর লেফট স্টপারের মাঝের ফাঁকা স্পেসে, টাচলাইনে তখন মলিনা আর ইনভার্টেড পজিশনে ডি মারিয়া। গোলটা এই ত্রিভুজটা থেকেই আসে। ম্যাকঅ্যালিস্টারের শটটা খুব যে ভাল লেগেছে তা নয়, তবে পায়ের পেছনের দিকে লেগে এমন একটা কোণ তৈরি করে যে চেজনি হাত ছুঁড়েও কিছু করতে পারেননি।
গোলটা খাবার পরেও পোল্যান্ডের খুব একটা হেলদোল দেখা যায়নি। মেসিকে শোল্ডার চার্জ করে লেওয়ান্ডাস্কি মেসির কাছে ক্ষমা চাইতেই ব্যস্ত। মিলিক আর লেওয়ান্ডাস্কি দুজন লম্বা স্ট্রাইকার দলে থাকা সত্যেও দুজনকে নামিয়ে উইং থেকে ক্রস বা লঙ বল কোনটাই চেষ্টা করেনি পোল্যান্ড। রাউন্ড অব সিক্সটিনে মেক্সিকোর দয়ায় উঠেছে, ফ্রান্সের কাছে গাড়ি চাপা পড়বে।
দ্বিতীয় গোলটার ক্ষেত্রে ফার্নান্ডেজের বল ক্যারি করার ক্ষমতাটা আবার দেখা গেল। ফার্নান্ডেজ উপরে উঠে এলে ম্যাক অ্যালিস্টার মেসির জায়গায়, মেসি তখন পেনাল্টি বক্সে, ডি পলের সঙ্গে দেওয়া নেওয়া করে ম্যাক অ্যালিস্টার পাস দিলেন ফার্নান্ডেজকে, ফার্নান্ডেজ তিনজনের মধ্যে থেকে খুঁজে নিলেন আলভারেজের ডানপা। আর রোভিং স্ট্রাইকারদের এগুলো গোল করতেই হয়, চেজনির আয়ত্ত্বের বাইরে দিয়ে জালে ঢোকে।
এরপর রাউন্ড অব সিক্সটিন, অস্ট্রেলিয়া। সত্যি বলছি অস্ট্রেলিয়াকে দেখে চমকেছি কিছুটা। প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও ওরা গোল তুলে নিয়েছিল প্রথমে। সীমিত ক্ষমতায় ক্ষমতার বাইরে গিয়ে লড়েছে। কাল ডেনমার্ককে জায়গাই দেয়নি।
তবে, আর্জেন্টিনা যা খেলল, অর্থাৎ ঠিক সময়ে পিক করল তাতে কোয়ার্টার ফাইনালে ২০১৪ সালের সেমিফাইনালের পুনরাবৃত্তি হবেই ধরে নিতে পারি। যদি ডাচরা মার্কিনদের হারাতে পারে। মার্কিনদের কমবয়সী মাঝমাঠ যা খেলছে তাতে সহজ হবে না কাজটা।
আসলে ছোট দলগুলি শুরুর দিকে লড়াই দিলে আপসেট করতে থাকলে প্রতিযোগিতার মান বেড়ে যায়, কিন্তু উপরের দিকে গিয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলে। তখন ভারি দল না থাকলে সমস্যা। আর্জেন্টিনা সেমিতে ব্রাজিল বা স্পেন (আশা করছি) যাকেই পাক না কেন, একটা ভাল খেলা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকলাম। চোট আঘাত যেন সেটা নষ্ট করে দিতে না পারে।