বার্ট ট্রটম্যান ছিল জার্মান গোলরক্ষক, যিনি ‘হিটলার ইয়ুথ’-এর জুনিয়র ব্রাঞ্চে জয়েন করেছিল। হিটলারের পৈশাচিকতা ও জার্মান ফুটবলারদের (অনেকেই) হিটলার প্রীতি থাকার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে কেউ খেলতে যেত না। যুদ্ধের পর অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানি অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। তাই ১৯৫৪ সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ ছিল তাদের জন্য হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের মিশন। শিরোপা জয়ের চাইতেও সেটা ছিল তাদের কাছে অগ্রগণ্য।
হাঙ্গেরি দল তখন বিশ্ব শাসন করতো। পুসকাস, ককসিস, চিবর, হিদেকুটিদের ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স’ নামে অভিহিত করা হতো। হাঙ্গেরি সেই আসরে ২৭ গোলের রেকর্ড করেছিল, যা এখন অবধি কেউ ভাঙতে পারেনি। প্রথম পর্বে জার্মানি হাঙ্গেরির কাছে হারে ৮-৩ গোলে!
অথচ চূড়ান্ত ম্যাচে গিয়ে পরিবর্তিত এক দল হয়ে যায়। ফাইনালের দিন বার্নে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি যেন সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে জার্মানির জন্য। বৃষ্টির কারণে হাঙ্গেরি খেলতে না চাইলেও জার্মান অধিনায়ক ফ্রিৎজ ওয়াল্টার যেভাবেই হোক খেলার ঘোষণা দেন।
শুষ্ক মাঠে খেললে কোনভাবেই জার্মানির জেতার কথা না, এটা জানা ছিল ওয়াল্টারের। তার চাপাচাপির ফলে ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে খেলতে নামতে হয় পুসকাসকে।
পুসকাসদের হারিয়ে অবশেষে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। ওই ফাইনালটি ‘ফ্রিৎজ ওয়াল্টার ওয়েদার’ নামে পরিচিত। বার্নে অনুষ্ঠিত ওই ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সদের সাথে জার্মানরা জিতে যাবে, তা খোদ জার্মানরাও ভাবেনি। ওই অবিশ্বাস্য জয়কে আজও তাই ডাকা হয় ‘মিরাকল অব বার্ন’ বলে।
১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কান্নার দৃশ্যটা মনে আছে? আর্জেন্টাইন সাপোর্টাররা সম্ভবত কখনও এডগার্ডো কোডেসালকে ক্ষমা করতে পারবে না এই কারণে।
আর্জেন্টিনা বনাম পশ্চিম জার্মানি। ১৯৮৬ এর পর ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালেও তারা মুখোমুখি। আজ থেকে ৩২ বছর আগের ওই ফাইনালে এডগার্ডো কোডেসালই ছিল মাঠের বিধাতা। ইতালিতে অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ম্যাচটা হেরে যায় ম্যারাডোনা, গায়কোচিয়াদের দল।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে দুই লাল কার্ড দেখানো, আর্জেন্টিনার দাবি করা একটা ‘ন্যায্য’ পেনাল্টি না দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেখা যায় খেলার শেষ দিকে। ৮৫ মিনিটে বিতর্কিত পেনাল্টি দেওয়া হয় জার্মানির পক্ষে।
পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্রেহমে। সেই গোলই নির্ধারণ করে দ্যায় ম্যাথিউসদের চ্যাম্পিয়নশিপ ও ম্যারাডোনার কান্নার উপলক্ষ। ম্যারাডোনা পরে বলেছিল, কোডেসাল আর্জেন্টিনার ‘স্বপ্ন চুরি’ করেছে।
ওই দুই আসরে (১৯৫৪ এবং ১৯৯০) জার্মানিকে নিয়ে প্রচুর বিতর্ক ও সমালোচনা তৈরি হয়। মাঠের বাইরেও তাদের খেলার কথা ওঠে। নব্বইয়ের ফাইনালে ‘কোডেসাল’-এর বিতর্কিত রেফারিং জার্মানির বিপক্ষে আরও অনেক জনশ্রুতি উস্কে দেয়। আবার এটাও ঠিক যে– দলগুলোর ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি, হার্ড ট্যাকলের জন্য ওই বিশ্বকাপে রেফারিদেরও বেশ কঠোর হতে হয়েছিল। ১৬ টি লাল কার্ডের ব্যবহারই যার প্রমাণ।
পরিশেষে বলতে হয়, জার্মানি আর্জেন্টিনা অথবা যাদের বিপক্ষেই অভিযোগ উঠুক না কেন, মনে রাখতে হবে– অভিযোগ ওঠা মানে অপরাধী নয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল তাকে অপরাধী বলা যায়। তার আগে নয়।
আমাদের সমাজে এমন অহরহ উদাহরণ পাওয়া যায় (‘অ্যাম্বার হার্ড কেস’, ‘মি টু মুভমেন্ট’ অথবা ‘রেস্টুরেন্টে কুকুরের মাংসের গুজব’ ইত্যাদি), যেগুলোতে প্রমাণ সাপেক্ষে সাধারণ জনগণ কথা বলে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অথবা গুজব ছড়ালেই তারা সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে। তার কোন অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও। এটা হবার নয়।
তাছাড়া, আদিযুগে প্রযুক্তির স্বল্পতা ছিল। স্পোর্টস টেকনোলজির এতো জয়জয়কার ছিল না। যার ফলে প্রচুর মনুষ্য ত্রুটি হতো, বিতর্ক উঠতো। ধীরে ধীরে এটা কমে এসেছে। এখন আমরা এক দুইটা ফুটবল অথবা ক্রিকেট ম্যাচ দেখলে বুঝতে পারি যে, রেফারি বা আম্পায়ারের ভুলগুলো মানবিক। প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা সেগুলোকে খুব সহজে আইডেন্টিফাই করতে পারি। ফলত বলা যায়, প্রযুক্তির ব্যবহার খেলাটাকে আরও নিখুঁত করে তুলছে। খেলাটাতে বেশি পরিমাণে যথাযথ ফলাফল এনে দিচ্ছে।