বিশ্বকাপে প্রতিটি দলেই অভিবাসী ফুটবলার রয়েছেন। গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স দলের অর্ধেকের বেশি ফুটবলারের জন্মই অন্য দেশে। স্পেনকে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে শেষ আটে পা রাখা মরক্কোও ব্যতিক্রম নয়। তাঁদের স্কোয়াডের ১৬ জন ফুটবলারের জন্মই মরক্কোর বাইরে।
তবে আজকের এই পর্যায়ে আসতে মরক্কোকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ভীষণ। এমনকি অন্য দেশে জন্ম নেয়া কিংবা অভিবাসীদের ফুটবলার হিসেবে খেলানোর নিয়ম পরিবর্তনেও ছিল মরক্কোর অবদান। ২০১৮ সালে সেবার ফুটবল মাঠে বেশ বাজে সময় কাটাচ্ছিল দলটি। তাঁদের কোচ হিসেবে ছিল হার্ভে রেনার্ড। নামটা পরিচিত ঠেকছে কি? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে হারানো সৌদি আরবের কোচ ছিলেন এই ভদ্রলোক।
মরক্কো দলটাতে সে সময় তারকা কোনো ফুটবলার ছিলেন না, দলগত ফুটবলই ছিল তাঁদের ভরসা। বার্সার একাডেমি লা মাসিয়াতে সে সময় আলো ছড়াচ্ছেন মরোক্কান বংশোদ্ভুত মুনির এল হাদ্দাদি। স্পেনের বয়সভিত্তিক দলের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও এক ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন এই তরুণ। কিন্তু মুনির ক্রমেই বুঝতে পারেন স্পেনের তারকা ঠাসা দলে নিয়মিত সুযোগ হবে না তাঁর। ফলে তিনি রাজি হয়ে যান মরক্কোর হয়ে খেলবার জন্য। কিন্তু বাদ সাধে ফিফার আইন।
মরক্কোর ক্রমাগত আবেদনের ফলে ফিফারও টনক নড়ে। তাঁরা রাজি হয় নিয়ম সংশোধন করতে, নতুন নিয়ম হয় অন্ততপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নামতে হবে। অন্যথায় অন্য দেশের হয়ে মাঠে নামতে কোনো সমস্যা হবে না ফুটবলারকে। অবশেষে ২০২০ সালে মরক্কোর হয়ে খেলার অনুমতি পান মুনির।
কিন্তু ততদিনে পুরনো ধার হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ফলে মরক্কোর হয়ে বেশিদিন মাঠে নামা হয়নি তাঁর। কিন্তু উপকার হয়েছে মরক্কোর ভবিষ্যৎ ফুটবল দল গড়ার ক্ষেত্রে। এবারের বিশ্বকাপ দলের বেশিরভাগ ফুটবলারের সামনেই সুযোগ ছিল অন্যদেশের হয়ে ক্যারিয়ার গড়ার।
কিন্তু, তাঁদেরকে রাজি করিয়েছে মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশন, গড়ে তুলেছে দারুণ এক দল। এবারের বিশ্বকাপে তাই ক্রোয়েশিয়া এবং বেলজিয়ামের সাথে একই গ্রুপে থাকলেও দ্বিতীয় পর্বে উঠতে সমস্যা হয়নি তাঁদের। বেলজিয়ামের বিপক্ষে তাঁদের ২-০ গোলের জয়কে অঘটন বিবেচিত হলেও তাঁদের শক্তিমত্তার সাপেক্ষে মোটেই তা নয়।
ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিয়মিত একদল ফুটবলারকে নিয়ে দারুণ এক দল সাজিয়েছে তাঁরা। দলের অন্যতম সেরা তিন তারকা- প্লেমেকার হাকিম জিয়েশ, রাইটব্যাক নৌসায়ের মাজরাউই এবং মিডফিল্ডার সোফিয়ান আমরাবাট তিনজনেরই জন্ম নেদারল্যান্ডে। পিএসজি তারকা আশরাফ হাকিমির জন্ম স্পেনে, রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে এসেছে তিনি। অন্যদিকে দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়ে জয়ের নায়ক গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনোর জন্ম কানাডাতে। অধিনায়ক রোমান সাইস এবং উইংগার সোফিয়ানে বৌফালের জন্ম ফ্রান্সে।
তাঁদের স্কোয়াডের ২৬ জন ফুটবলারের মাঝে ১৬ জনের জন্ম কিংবা বেড়ে উঠা মরক্কোর বাইরে। এমনকি তাঁদের কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুইয়ের জন্ম প্যারিসে হলেও জাতীয় দলের প্রশ্নে বেছে নিয়েছিলেন মরক্কোকেই। তবে কেবল মরক্কোই নয়, এবারের বিশ্বকাপে একশোর বেশি ফুটবলার রয়েছেন যারা জন্মস্থানের বদলে বিশ্বকাপে বেছে নিয়েছেন অন্য দলকে।
১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে নক আউট পর্বে উঠেছিল মরক্কো। এবারের বিশ্বকাপে তাঁদের লক্ষ্যটা আরো বড়, কোনো আফ্রিকান দলই এখনো পর্যন্ত সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি। মরক্কোর সামনে সুযোগ প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেই মাইলফলক স্পর্শ করার, অন্য দলগুলোর অনুপ্রেরণা হওয়ার। এখন দেখার বিষয় কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে হারাতে পারেন কিনা জিয়েশ-বোনোরা।