১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনাময় মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ের পর কেটেছে অজস্র রাত। আর সেসব রাতে আরও একটি সোনালী ট্রফির স্বপ্ন দেখেছিল আর্জেন্টিনার ফুটবলার আর ভক্ত-সমর্থকরা। এই সময়ে কখনো হৃদয় ভেঙ্গেছে আবার কখনো লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়েছে। তবে এবার ফুরিয়েছে অপেক্ষা, তিন যুগ ধরে মনের কোণে লালিত স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে; আরাধ্য শিরোপাটা অবশেষে যাচ্ছে ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেশে।
লিওনেল মেসি যখন কাতার বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন, তিনি তখন কি মনে মনে কাউকে খুঁজেছিলেন? হয়তো খুঁজেছিলেন, খুঁজেছিলেন আর্জেন্টিনার সবচেয়ে একনিষ্ঠ ভক্ত ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে।
ক্যারিয়ারে এর আগে প্রতিটি বিশ্বকাপ আসরেই তো বড় ভাইয়ের মত কাছে পেয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে; কোচ কিংবা সমর্থক হিসেবে আলবিসেলেস্তাদের সাফল্য কামনা করেছিলেন এই কিংবদন্তি। কিন্তু আরাধ্য স্বপ্ন যখন সত্যি হয়েছে, তখন স্টেডিয়ামে দুই হাত উপরে তুলে কাউকে উল্লাস করতে দেখা যায়নি।
১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা, কিশোর ম্যারাডোনা সেটা দেখেছিলেন, ১৯৮৬ তে নিজেই অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। কিন্তু প্রিয় আর্জেন্টিনার জার্সিতে তিন নম্বর তারা যুক্ত হওয়ার ক্ষণ দেখা হয়নি তাঁর; অনেক দিন আগেই তো জীবনের হিসেব চুকিয়ে ফেলেছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা এখন থাকলে হয়তো শিশুর মতই উচ্ছ্বসিত হতেন, ভাসতেন আনন্দের ভেলায়। ম্যারাডোনার সম্ভাব্য অনুভূতি নিয়ে অবশ্য কোন সন্দেহ নেই তাঁর বড় সন্তান ডিয়েগো ম্যারাডোনা সিনাগ্রা। ডিয়েগো জুনিয়র বলেন, ‘তিনি (বাবা) নিশ্চয়ই এই দলকে ভালবাসতেন। স্বর্গ থেকেই এই ছেলেদের উপভোগ করছেন তিনি।’
বর্তমানে কোচিং ক্যারিয়ারে যুক্ত থাকা ডিয়েগো আরও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, আমার বাবা ছেলেদের খেলা দেখে গর্ববোধ করছে। তারা যেভাবে আর্জেন্টিনার জন্য লড়াই করেছে সেটি সত্যিই প্রশংসনীয়। বাবা যেখানেই আছেন তিনি এখন গর্বিত অবস্থাতেই আছেন।’
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপের তুলনা করেন অনেকে। কেউ আবার একই মানদণ্ডে মাপতে চান সে সময়কার ম্যারাডোনা আর বর্তমানের মেসিকে। এই দুইজনেই নিজেদের সময়ের সেরা খেলোয়াড়, অর্জনের হিসেবেও রয়েছে সাম্যতা।
কিন্তু দুই প্রজন্মের দুই খেলোয়াড়ের মাঝে তুলনা করতে মোটেই আগ্রহী নন ডিয়েগো ম্যারাডোনার ছেলে। তিনি জানান, এখন সময়টা মেসিকে উপভোগ করার, ঠিক যেভাবে নব্বইয়ের দশকে সবাই ম্যারাডোনাকে করেছে। আমি তাদের দু’জনের মাঝে তুলনা করতে চাই না কারণ আমি মনে করি এটির কোন যৌক্তিকতা নেই।
ডিয়েগো জুনিয়র মনে করেন দুই প্রজন্মের দুই খেলোয়াড়ের মাঝে অহেতুক তুলনা ভালো কিছু বয়ে আনে না, ‘মেসি এবং ম্যারাডোনার গল্পটা একই, আমি নিজেও মেসির গুণমুগ্ধ। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা মেসি ম্যারাডোনার আলিঙ্গনরত ছবিটি আমার খুবই পছন্দ।’
লিওনেল মেসি এবং ডিয়েগো ম্যারাডোনা দুইজনেই খেলেছেন দুইটি বিশ্বকাপ ফাইনাল; একবার হেসেছেন শেষ হাসি আর একবার ভেঙেছে হৃদয়। তবে বিশ্ব মঞ্চে গোল করার ক্ষেত্রে নিজের পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন আর্জেন্টিনার বর্তমান অধিনায়ক, যদি অ্যাসিস্টের হিসেবে একই স্থানে আছে তাঁরা।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর লিওনেল মেসি – এই দুইজনকে বুঝতে সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োজন আসলে নেই, প্রয়োজন নেই অর্জনের দিকে তাকানোর। স্ব স্ব প্রজন্মকে পায়ের জাদুতে কাছে টেনেছেন তাঁরা, বাধ্য করেছেন ফুটবলকে ভালবাসতে। তাই তো অবসরের তিন দশক পরেও একবিন্দু জনপ্রিয়তা কমেনি ম্যারাডোনার; আগামী কয়েক দশকেও হয়তো একই ভাবে বিরাজ করবে লিওনেল মেসির প্রতি মানুষের ভালবাসা।