দিলীপ দোশি, লোকটা আলাদা

সত্তরের দশকের যারা ক্রিকেট দর্শক তাঁদের জন্য দুনিয়াটা কয়েকটা ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগে ছিলেন ব্যাগি গ্রিন পরিহিত গোঁফধারী অস্ট্রেলিয়ানরা। অন্যদিকে ছিলেন মহাপরাক্রমশালী ভয়ডরহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’দলেরই বিশেষত্ব ছিল পেস বোলিং। আর ইংল্যান্ড ছিল পেশাদার ভদ্রলোকের দল।

ভারতের বৈশিষ্ট কি ছিল? মোটা দাগে ভারত তখন ছিল স্পিনারদের দল। ভারতকে বলা হত ‘হোম অব স্পিন’। ভারত তখন খ্যাতনামা স্পিন চতুষ্টয়ের সাথে বিশ্বকে পরিচয় করে দিয়েছিল – এরাপল্লি প্রসন্ন, শ্রীনিবাস ভেংকটরাঘবন, ভগবত চন্দ্রশেখর আর বিষেন সিং বেদি। এই চারজনের সুবাদে ভারতে আর যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, তারা পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি।

বাঁ-হাতি স্পিনার রাজিন্দর গোয়েল ছিলেন, ছিলেন রাজিন্দর হান্স ও পদ্মকর শিভালকর, অফ স্পিনার শিবলাল যাদব ছিলেন। আরো ছিলেন দিলীপ দোশি, বাঁ-হাতি স্পিনার।

বয়স যখন ৩২ বছর, তখন গিয়ে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়। ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি খুবই নগন্য, দেখতে একদমই অ্যাথলেট ঘরানার নন। আচড়ানো চুল ও মোটা চারকোনা চশমার ফ্রেমে তাঁকে দেখে তাঁকে আর যাই হোক পেশাদার ক্রিকেটার বলে মনে হত না। যদিও, তার এই বাহ্যিক গড়ন ও দেখনশৈলি দিয়ে তাঁর বোলিংয়ের ‘ডাবল মিনিঙ’ আর লুকানো গভীরতা যাচাই করতে গেলে বিপদে পড়তে হবে। তিনি ছিলেন আক্রমণাত্মক, ধৈর্য্যশীল ও অনুসন্ধানী।

অভিষেক টেস্ট ইনিংসেই স্বয়ং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চেন্নাইয়ে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন। ৩৩ টেস্ট, ১৫ ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৩৬ টি আন্তর্জাতিক উইকেট – এমন পরিসংখ্যানটা তাঁর সাথে ঠিক যায় না।। এর মধ্যে চার কিংবা তার বেশি উইকেট পেয়েছেন ১২ বার। তারপরও দোশির আরো কিছু দেওয়ার ছিল। যদি আরেকটু আগে সুযোগ পেতেন – তাহলে হয়তো আরো বেশি জাদু দেখাতে পারতেন।

দেশের হয়ে অভিষেক হওয়ার আগেই ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে দোশি খুব সম্মানিত ছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে তাঁর জুড়ি পাওয়া দুস্কর ছিল। কঠিন পাটা উইকেটেও ফুল ফোটাতে জানতেন। তাই অভিষেকের পরই তিনি কার্যত কপিল দেবের বোলিং বিভাগের নেতা বনে গিয়েছিলেন। অন্য কোনো সময়ে জন্মালে হয়তো দিব্যি দেশের হয়ে ১০০ টা টেস্ট খেলে ফেলতেন। তবে, পদ্মকর শিভালকর কিংবা রাজিন্দর গোয়েলদের পথেই হাঁটতে হয়েছে তাঁকে। ছিলেন বিষেন সি বেদির ছাঁয়া হয়ে।

তবে, একটা অনন্য রেকর্ডের ভাগিদার তিনি আজো আছেন। ৩০ বছর বয়সের পর গিয়ে টেস্টে অভিষেক হওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি যার ঝুলিতে ১০০’র বেশি উইকেট আছে। তিনি মাত্র ২৮ টেস্ট খেলেই ১০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছান। অপরজন হলেন অজি লেগ স্পিনার ক্ল্যার গ্রিমেট।

১৯৮০-৮১ মৌসুমের অস্ট্রেলিয়ান সফরটা দোশির জন্য স্মরণীয় ছিল। একালে ইয়ান বোথাম কিংবা অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফরা প্রতিপক্ষ হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ায় যেমন ‘শত্রুপরায়ন’ আতিথ্য পায় তেমনই পেয়েছিলেন দোশি। মেলবোর্নে ৭৪ ওভার বোলিং করেছিলেন, পায়ের হাড়ে ফাঁটল থাকার পরও। হ্যাঁ, মনোবল থাকে শারীরিক সমস্যা কোনো ঘটনাই ছিল না দোশির জন্য। এতটাই সাহসী, একগুঁয়ে আর ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন তিনি।

বল হাতে তিনি যেকোনো মুহূর্তেই থাকতেন প্রস্তুত। ফিল্ডিং নিজের মত মত যখন সাজাতেন, তখন সেটা দেখার মত একটা দৃশ্য ছিল। মনে হত যেন যুদ্ধে নামছেন। স্পিনারদের কাজ কেবল ওভার রেট বাড়িয়ে দেওয়া যে না – সেটা বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন তিনি!

সিডনিতে গ্রেগ চ্যাপেল তাঁর বিরুদ্ধে ভাল রান করেছিলেন। পরের টেস্টে অ্যাডিলেডে দোশি সেই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন দুই ইনিংসেই আউট করে। গ্রেগ চ্যাপেল যখন মাথা নিচু করে প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন, তখন তাঁর ভাবভঙ্গি একটা কথাই যেন বলছিল, ‘টু গুড!’

হ্যাঁ, দোশি ‘টু গুড’ই ছিলেন। কিন্তু, বেস্ট ছিলেন না। যদিও, যাকে ‘বেস্ট’ বলা হয় সেই বিষেন সিং বেদির চেয়ে স্ট্রাইক রেট বা গড় – কোনোটাতেই খুব একটা পিছিয়ে ছিলেনা দোশি। ওয়ানডে খুব বেশি খেলেননি, মানাতেও পারেননি। তবে, কাউন্টি সানডে লিগ ম্যাচে একবার আট ওভার বোলিং করে সাতটা মেইডেন নিয়েছিলেন, এক রান দিয়ে পেয়েছিলেন এক উইকেট।

দোশির ক্যারিয়ারটা বেদি থাকার পরও আরেকটু বড় হতে পারতো। কিন্তু, সেটা হয়নি কারণ তিনি নাকি সুনীল গাভাস্কারের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে পারেননি। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘স্পিন পাঞ্চ’-এও তিনি বলে গেছেন, দল কেমন হবে সেটা সুনীল গাভাস্কারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর অনেকটা নির্ভর করতো!

দোশির জন্ম রাজকোটে হলেও বেড়ে উঠেছেন কলকাতার জল হাওয়ায়। বাবার ব্যবসা ছিল কলকাতাতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিলেন দোশি। বাংলা দলের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ২০ বছর বয়স থেকেই। দিলীপ দোশি ক্রিকেটের বানিজ্যিকরণের বড় বিরোধীপন্থীদের একজন ছিলেন। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি এই নিয়ে খোদ তৎকালীন ভারতীয় দলেরও সমালোচনা করেন।

যদিও, নিজের জীবদ্দশাতেই ছেলে নয়ন দোশিকে তিনি অর্থের ‘সবচেয়ে বড় কুয়া’ বলে পরিচিত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলতে দেখেছেন। নয়ন নামী ক্রিকেটার ছিলেন, সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জি খেলেন। আইপিএলে দু’টি মৌসুম খেলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু ও রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে। বাবার মত তিনিও ছিলেন বাঁ-হাতি স্পিনার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চার বছর ছিলেন দোশি। তার বিষয়ে গ্যারি সোবার্স আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি অবাক হই, কেন আরো অনেকের মত নিজের সেরা সময়ে সময়ে দোশি নিজের দেশের হয়ে খেলতে পারলেন না, তখন তিনি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর বোলারদের একজন ছিলেন। স্পিনারদের সবরকমের বৈচিত্র, ফ্লাইট বা কনট্রোল – সবই ছিল তাঁর মধ্যে!’

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link