পম্পাইয়ের মুর্তির সামনে জুলিয়াস সিজারের নিথর দেহটা যখন পড়ে গেল তখন তাঁর বুকে গুণেগুণে ২৩ টা ছুড়ির দাগ। নারকীয় উল্লাসে তখন জুলিয়াসের স্নেহভাজন ব্রুটাস-ক্যাসিয়াস। বন্ধুত্বের শেষ পাতাটা লেখা হয়েছিল সেই দিন। বিশ্বাসঘাতকতার বিষবায়ু সেদিন থেকেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গিয়েছিল এ বিশ্বের হৃদয় দেওয়ালে।
তার কয়েক হাজার বছর পর। সময়টা নব্বই দশক। ম্যাচ ফিক্সিং, গড়াপেটা কাণ্ডে ভারতের ধরিত্রীতে বিষবাস্পের প্রবেশিকা ধ্বনিত হচ্ছে মিডিয়ার সিডিউলড নগ্নখেলায়। কপিল দেবের নামে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে তাঁরই স্নেহভাজন মনোজ প্রভাকর।
হঠাৎ পরিবর্তন। যে অধ্যায়টা শেষ হয়েছিল ব্রুটাসের বিশ্বাসঘাতকতার কালো কালিতে, তার কয়েক হাজার বছর পর কোন দুই মহাপুরুষ যেন এলেন সেই ধ্বংশাবশেষের মাটিতে। একজন ডানহাতি একজন বাঁ-হাতি। একজনের ব্যাটে চকচক করছে ব্র্যান্ড ‘এমআরএফ’। আরেকজনের তলোয়ারে লেখা ‘এসএস’।
ক্রিজের সাদা চিকটা বুটটা দিয়ে হালকা ঘষে নিল একজন। তারপর ব্যাটটা মিড উইকেটে রেখে চোখ পিটপিট করে তাকালেন অপরপ্রান্তে তার ছোটে বাবুর দিকে। ঈশারায় বুঝিয়ে দিলেন, ‘আমি শেন ওয়ার্নকে সামলে নেব, তুই গ্লেন ম্যাকগ্রাকে তুই দেখে নিস।’
শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।
শেষ পাতায় ব্রুটাসের বিশ্বাসঘাতকতার যে চ্যাপ্টারটা ছিল সেটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আবার নতুন করে এক বই লেখা শুরু করলো সেই দুজন। সেই বইয়ের নাম কি জানেন? –‘বন্ধুত্ব’। পালা করে ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি-জেসন গিলেস্পি, ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুস, চামিন্দা ভাস-মুত্তিয়া মুরালিধরণদের অহংকারের বর্ম ভেদ করে আভিজাত্যের তলোয়ার চালাতে লাগল সেই দুজন।
ভারতের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকল স্যার ডন ব্র্যাডমানের দেশ থেকে কিউই পাখির চিলেকোঠায়। কখনওবা স্যুইংয়ের দেশে, কখনও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর আগ্নেয় পিচে।
বদলাবে যুগ। বদলাবে সময়। ক্রিকেটমঞ্চে আলোড়িত হবে অনেক নাম, অনেক ঘটনা। কিন্তু সেই দ ‘জনের নাম শুনলে একখানা গোটা ভারতবর্ষ আচ্ছাদিত হবে স্মৃতিবিজারনের মেঘে। তাঁদের মনে পড়বে নব্বই দশক। মনে পড়বে চোখ পিটপিট করতে করতে লম্বা ছেলেটা হাত রেখেছে তাঁর প্রিয় সেই ছোটে বাবুর কাঁধে।
একখণ্ড গোটা ভারতবর্ষকে মাথায় রেখে তারা হেঁটে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির উপর দিয়ে,এগিয়ে চলেছে ১৯৯৯ এর বেটিং শিরোনাম থেকে ২০০৩-এর সেই জোহানের্সবার্গের ফাইনালে। আর সেই স্মৃতিবিজারনের মেঘ ঘনীভূত হয়ে যখন এক পশলা বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে,তখনই গোটা ভারতবর্ষ উচ্চারণ করে তাদের নাম। একসাথে। একস্বরে। একসুরে। একরাগে। নাম তাদের শচীন-সৌরভ। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলি।
যতদিন জুলিয়াসের বুকে ব্রুটাসের ছুড়ির দাগ থাকবে,ততদিন তার ভেষজ পাথেয় হিসাবে থাকবে দুটি গোলাপের রস – শচীন ও সৌরভ আর একখানা গোটা ভারতবর্ষ। তাঁদে মত কেউ আসেনি, হয়তো আর আসবেও না।