বিশ্বকাপের পরের ট্রান্সফার উইন্ডো বরাবরই জমজমাট হয়ে থাকে। বৈশ্বিক আসরে আলো ছড়ানো নতুন তারকাদের প্রতি আগ্রহী থাকে ইউরোপের বড় দলগুলো। এছাড়া ছোট দলগুলোও রেলিগেশন এড়াতে ব্যস্ত থাকে দলের শক্তিমত্তা বাড়াতে। আসুন দেখে নেয়া যাক এবারের শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর সেরা দলবদল।
- ইয়ান সমার (বরুশিয়া মুনশেনগ্লাডবাখ থেকে বায়ার্ন মিউনিখ)
ম্যানুয়েল নয়্যারের ইনজুরি এবং সভেন উলেরিখের ভুল করার অভ্যাস থাকায় মৌসুমের মাঝপথে গোলকিপার নিয়ে ভালোই বিপাকে পড়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ।
তবে জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোতেই সাময়িক সমস্যার সমাধান বের করেছে ফেলেছে দলটি। মুনশেনগ্ল্যাডবাখ থেকে সুইস কিপার ইয়ান সমারকে দলে টেনেছে বাভারিয়ানরা। সমার ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় পারফর্ম করলেও থেকে গেছেন লাইমলাইটের বাইরে। এবার তাঁর সামনে সুযোগ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেবার।
- লিয়ান্দ্রো ট্রসার্ড (ব্রাইটন থেকে আর্সেনাল)
একই শহরের প্রতিদ্বন্দী দলের সেরা খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীরা – এমন দৃশ্য ফুটবলে হর-হামেশা দেখা যায় না। তবে এবারের মৌসুমে ব্রাইটনের লিয়ান্দ্রো ট্রসার্ডকে ২৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে টেনেছে পয়েন্ট তালিকার এক নম্বর দল আর্সেনাল।
এবারের মৌসুমে ব্রাইটনের সেরা ফুটবলার ছিলেন ট্রসার্ড। কিন্তু কোচ দে জারবির সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ক্লাব ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন তিনি। সুযোগটা নিতে ভুল করেনি আর্সেনাল, তাঁদেরও আক্রমণভাগে অপশনের প্রয়োজন ছিল। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে গানার্স শিবিরে যোগ দিয়েছেন এই বেলজিয়ান।
- মালো গুস্তো (লিওন থেকে চেলসি)
এবারের মৌসুমের শুরুতেই নিয়মিত রাইটব্যাক রিস জেমসের ইনজুরির সুবাদে ভালোই ভুগতে হয়েছে চেলসিকে। ফলে টড বোহেলি যেন জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোর অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। ফলে প্রথম সুযোগেই তিনি দলে ভিড়িয়েছেন মালো গুস্তোকে।
উয়েফার ফিন্যান্সিয়াল নিয়মের কারণে আপাতত ধারে চেলসিতে যোগ দিয়েছেন গুস্তো। তবে মৌসুম শেষে ১৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পাকাপাকিভাবেই চেলসিতে খেলবেন তিনি।
- হ্যারি সুটার (স্টোক সিটি থেকে লেস্টার সিটি)
ওয়েস মরগ্যানের পর আর রক্ষণভাগে ভরসা করার মতো কাউকে পায়নি লেস্টার সিটি। মাঝে তরুণ ফোফানা আলো ছড়ালেও গত মৌসুমে চেলসিতে নাম লিখিয়েছেন তিনি। ক্যাগলার সয়ঞ্চু, উউট ফায়েস, জনি ইভান্সরা ইনজুরিতেই কাটিয়েছেন মৌসুমের বেশিরভাগ সময়।
সেই কারণেই ট্রান্সফার ডেডলাইনের একদম শেষদিনে স্টোক সিটির তরুণ সেন্টার্যাক হ্যারি সুটারকে দলে ভিড়িয়েছে দ্য ফক্সেসরা। বল পায়ে দক্ষ সুটার এরিয়াল বলেও দুর্দান্ত। ফলে মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধটা খানিকটা নির্ভার থাকার আশা করতেই পারে লেস্টার।
- ইলিয়া জাবারনি (ডায়নামো কিয়েভ থেকে বোর্নমাউথ)
এবারের জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোতে কেবল বড় দলগুলো নয়, বরং ছোট দলগুলোও ছিল সমান সক্রিয়। বোর্নমাউথের কথাই ধরুন না কেন, মাতিয়াস ভিনা, হামাদ ট্রায়োরে এবং ইলিয়া জাবারনিকে দলে ভিড়িয়েছে রেলিগেশন শঙ্কায় থাকা দলটি।
এর মাঝে জাবারনির সাইনিংটা ছিল চমক জাগানিয়া। ইউক্রেনের অন্যতম সেরা এই তারকাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী ছিল ইউরোপের বড় দলগুলো। জাতীয় দলের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দারুণ পারফর্ম করে সবার নজর কাড়েন এই সেন্টারব্যাক। তাঁকে দল টানতে বোর্নমাউথের খরচ হয়েছে ২০ মিলিয়ন ইউরো।
- বেনোয়িট বাদিয়াশিলে (মোনাকো থেকে চেলসি)
এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে চেলসি। রক্ষণে শক্তি বাড়াতে গত গ্রীষ্মেই নাপোলি থেকে কালিদু কুলিবালিকে দলে ভিড়িয়েছিল দলটি। কিন্তু তাঁর অফফর্মের কারণে এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতেও সেন্টারব্যাক কিনতে হয়েছে নর্থ লন্ডনের ক্লাবটিকে।
মোনাকো থেকে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ব্লুজদের দলে নাম লিখিয়েছেন বেনোয়িট বাদিয়াশিলে। বাদিয়াশিলেকে বিবেচনা করা হয় ফরাসি ফুটবলের সেরা প্রতিভা হিসেবে। এখন দেখা যাক, গ্রাহাম পটারের ট্যাকটিক্সে মানিয়ে নিতে পারেন কিনা এই তারকা।
- আজ্জেদিনে ওনাহি (অ্যাঞ্জার্স থেকে মার্শেই)
অবশেষে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোর নজর এড়িয়ে ভিন্ন লিগের কোনো দলে যোগ দিয়েছেন তরুণ কোনো প্রতিভা। এবারের বিশ্বকাপ দিয়েই সবার নজরে এসেছেন মরক্কোর মিডফিল্ডার আজ্জেদিন ওনাহি। অ্যাটলাস লায়ন্সদের সেমিফাইনাল যাত্রায় প্রতিটি ম্যাচেই মাঠে নেমেছেন এই তরুণ।
বিশ্বকাপ শেষে প্রথম সুযোগেই তাই এই ফুটবলারকে দলে টেনেছে ফরাসি ক্লাব মার্শেই। গার্সনকে ফ্ল্যামেঙ্গোর কাছে বিক্রির পর মার্শেইয়ের প্রয়োজন ছিল নতুন এক মিডফিল্ডারের। ওনাহিকে দলে টেনে সেই অভাব পূরণ করলেন ইগর ট্রুডো।
- পেদ্রো পোরো (স্পোর্টিং সিপি থেকে টটেনহ্যাম)
পেদ্রো পোরোর জন্য এ যেন ঘরে ফেরা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানসিটির হয়ে শুরু। কিন্তু পেপ গার্দিওলার তারকাবহুল দলে সুযোগ মেলেনি। তাই নিজেকে প্রমাণের লক্ষ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর পর্তুগালে।
সিপির হয়ে দারুণ পারফর্ম করে নজর কাড়েন গোটা বিশ্বেই। গুঞ্জন ছিল রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেবার। কিন্তু শেষপর্যন্ত ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে নাম লিখিয়েছেন আন্তোনিও কন্তের টটেনহ্যামে।
- মিখাইলো মুরদিক (শাখতার দোনেৎস থেকে চেলসি)
মিখাইলো মুরদিক আর্সেনালে নাম লেখাচ্ছেন এমন গুজব ছিল গত গ্রীষ্ম থেকেই। মুরদিক নিজেও গানার্সদের হয়ে খেলার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু শেষদিকে এসে টড বোহেলি ১০০ মিলিয়ন ইউরোর পাগলাটে এক ট্রান্সফার ফি’তে দলে টানেন তরুণ এই উইংগারকে।
জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোর পুরোটা জুড়ে ইঁদুর-বেড়াল লড়াই চলেছে আর্সেনাল আর চেলসির মাঝে। তবে মুরদিকের বেলায় শেষ হাসি হেসেছে বোহেলির চেলসিই।
- জোয়াও ক্যানসেলো (ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বায়ার্ন মিউনিখ)
এবারের উইন্ডোর সবচেয়ে চমক জাগানিয়া দলবদল জোয়াও ক্যানসেলোর ম্যানসিটি ত্যাগ। পেপ গার্দিওলার অধীনেই আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে ভার্সেটাইল ফুলব্যাক হিসেবে বেড়ে উঠা। রাইটব্যাক হিসেবে শুরু করলেও বনে গেছেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা লেফটব্যাক।
কিন্তু টানা কয়েক ম্যাচ বেঞ্চে বসার জের ধরে ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন পর্তুগিজ এই তারকা। আপাতত ধারে যোগ দিলেও মৌসুম শেষে ৭০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাঁকে পাকাপাকিভাগে দলে ভেড়ানোর সুযোগ আছে বাভারিয়ানদের।
- এনজো ফার্নান্দেজ ( বেনফিকা থেকে চেলসি)
চেলসির মালিকানা পাবার পর থেকেই যেন দলে নতুন খেলোয়াড় ভেড়ানোর নেশা পেয়ে বসেছে টড বোহেলিকে। নর্থ লন্ডনের ক্লাবটির সর্বশেষ সংযোজন এনজো ফার্নান্দেজ। বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকাকে দলে ভেড়াতে ব্লুজদের খরচ হয়েছে ব্রিটিশ রেকর্ড ১০৬ মিলিয়ন ইউরো।
এনজো ফার্নান্দেজের দলবদল নিয়ে নাটক হয়েছে বিস্তর। ছয় মাস আগেই দলে আসা সোনার ডিম পাড়া হাঁস এত আগেই বিক্রিতে মোটেই আগ্রহী ছিল না বেনফিকা। সাফ জানিয়ে দিয়েছিল হয় ১২০ মিলিয়নের রিলিজ ক্লজ মেটাও, অন্যথায় কেটে পড়। চেলসি অবশ্য হাল ছাড়েনি, প্রস্তাবের পর প্রস্তাব পাঠিয়েছে বেনফিকার। অবশেষে শেষদিনে এসে মন গলেছে পর্তুগিজ ক্লাবটির কর্মকর্তাদের, ১০৬ মিলিয়নের রেকর্ড ফি’তে সম্মত হয় দুই দল।