মাঠের ক্রিকেট, মিথের ক্রিকেট!

‘টেস্ট হলো আসল ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই নয়, রেসলিং, এবং টি-টোয়েন্টির কারণেই ক্রিকেটের অধ:পতন ঘটছে বা ঘটে গেছে’ – ক্রিকেটে সময় বিনিয়োগ/অপচয় করেন, এবং সে বিষয়ে ৫-৭ লাইন লিখেন এমন ১৫ জন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করলে ১২ জনই উল্লিখিত মনোভাব পোষণ করেন।

মনোভাবের উৎস অনুসন্ধান বা যৌক্তিকতা অনুধাবনের উদ্দেশ্যেই লেখাটির অবতারণা। তবে, ক্রিকেট এখানে অনুষঙ্গমাত্র, পরিবর্তনের প্রতি সমাজের সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি আর এক্সপ্লোর প্রবণতা নিরীক্ষণই মূখ্য উদ্দেশ্য।

ফুটবল বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা। এর একটাই সংস্করণ। খেলাটা যতখানি জাতীয় দলকেন্দ্রিক, ক্লাবভিত্তিক গ্ল্যামারেও কোনো অংশে কম নয়। যে কারণে জাতীয় দলের হয়ে বৃহৎ সাফল্য না থাকলেও ক্লাব ফুটবলের কল্যাণে মেসি, রোনালদো, ইব্রাহিমোভিচরা জনপ্রিয় তারকা৷

ক্রিকেটের হিসাবটা এক্ষেত্রে অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পূর্ণ। দীর্ঘদিন পর্যন্ত খেলাটা আবদ্ধ ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যেকার দ্বান্দ্বিকতায়, যদিও প্রথমোক্ত দুই দলের মতো দক্ষিণ আফ্রিকা অতটা প্রভাববিস্তারি ছিল না।

শুরুতে এই খেলার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমাই ছিল না। এক পর্যায়ে এর সর্বোচ্চ সীমা পাঁচ দিনে স্থীর হয়। এই যে সময়ের দৈর্ঘ্য, এটাই খেলাটির কূপমণ্ডুকতার একমাত্র কারণ। এবং একুশ শতকের দ্রুত এবং ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজকাঠামোতে পাঁচ দিন ধরে কোনো এন্টারটেইনমেন্টে মানুষ নিমগ্ন থাকবে সেই সুযোগটিই অনিবার্য কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে।

তবে কি ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, যেমনটি অনেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছে? আলো-অন্ধকারের আলোচনা মুলতবি থাকুক, অন্তত আমাদের জীবদ্দশায় যে খেলাটি হারিয়ে যাবে না তার দুটো ইশারা লক্ষ্য করছি।

প্রথমত, জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশ ভারত, পঞ্চমে রয়েছে পাকিস্তান, এবং অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। তিনটি দেশের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জীবনাচরণে সাদৃশ্য রয়েছে, এবং জনপ্রিয়তায় ক্রিকেটকে টপকে যাবার মতো খেলা পাইপলাইনে নেই। সর্বশেষ ২০ বছরে পাকিস্তানের ক্রিকেটমান নিম্নমুখী হলেও তা সাউথ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভ্যন্তরীণ সংকট পর্যায়ের নয়।

ক্রিকেট পুরোপুরিই জাতীয় দলকেন্দ্রিক খেলা। সারা বছরই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ এত বেশি পরিমাণে অনুষ্ঠিত হয় যে ক্লাবের ধারণা তৈরি হওয়া দুরূহ। তারাই দর্শকদের কাছে তারকাখ্যাতি পায় যারা জাতীয় দলের হয়ে পারফর্ম করছে। ভারত বা শ্রীলংকার কোনো ক্রিকেটার ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লীগে রানের প্লাবন ঘটালেও দর্শকের কিছুই যায়-আসে না।

ক্রিকেটের সংস্করণ তিনটি। মৌলিক উপকরণগুলো একই। যেমন ১১ জন খেলোয়াড়, রান, উইকেট, আম্পায়ার। কিন্তু, নিয়ম-কানুনে পার্থক্যটা ব্যাপক মাত্রায়। ওয়ানডেতে চরম নৈপুণ্য দেখিয়েও কোনো দল ৩০০ বলের বেশি খেলার সুযোগ পাবে না, টেস্টে অল আউট না হওয়া পর্যন্ত খেলতেই থাকো। টি-টোয়েন্টিতে বল বরাদ্দ মাত্র ১২০ টি!  একটাতে পোশাক সাদা বল রঙিন, অন্যটায় বল সাদা পোশাক রঙিন। ফিল্ড রেস্ট্রিকশন, ওয়াইড, বাউন্সার সহ বিভিন্ন ধরনের নিয়ম।

 

গত ১০০ বছরে টেস্ট ক্রিকেটের মৌলিক নিয়মে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্টের কারণে বড়োসড়ো সামাজিক বিপর্যয়েও দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে, যেটা অন্য খেলার জন্য কিছুটা কঠিন।

কিন্তু, এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে যারা মানিয়ে নিতে পারছে না তারাই মূলত টেস্টই আসল ক্রিকেট, সীমিত ওভারের ক্রিকেট পিকনিক – স্লোগান তুলে নিজেদের রক্ষণশীল মনোভাবের ইগোপূর্তি করে। এটা অনেকটা ‘Peer Pressure’ এর অনুরূপ। শত বছরের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধাচরণ করতে গেলে কৌলিন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কে জাত বিসর্জন দিতে চায়!

কৌলিন্যের ভিতকে কটাক্ষ করা যেতেই পারে অবশ্য। যদি বলি দীর্ঘদিন অবধি মাত্র দুই দেশের তালুকদারির কারণে ক্রিকেট সংক্রান্ত আলোচনার ৬০%ই দাঁড়িয়ে আছে মিথের উপর, মূর্খ বলার জন্য দাঁড়িয়ে যাবেন অনেকেই। তাই  ডব্লিউ জে গ্রেস, ডন ব্র‍্যাডম্যানকে এখনকার ক্রিকেটে বাতিল ঘোষণা করলে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা ধরে নিয়ে, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়ার মানুষ পাওয়া যাবে অগণিত।

৬০-৭০ বা ১০০ বছর আগে যারা ক্রিকেট খেলত সেই ক্রিকেটে প্রফেশনালিজম কতটা ছিল আদতে? আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে, তখন দল মাত্র তিনটি; ১৯৬৫ তে যখন আইসিসির সংস্কার হয় তখনো কি ক্রিকেটে সেরকম বিনিয়োগ বা খেলোয়াড়দের আর্থিক নিরাপত্তা ছিল? কিংবা ১৯৮৯ তে আইসিসি যখন বর্তমানের আদলে আসে তখনো কি সেই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হয়েছে?

৫০-৬০ বছর আগেকার পৃথিবীর থেকে এখনকার পৃথিবী বদলে গেছে আমূল, ৩০ বছর পরের পৃথিবীও থাকবে না এখনকার মতো। পৃথক সময়রেখায় বসবাস করা মানুষের কার্যক্রমের মধ্যে তুলনা টানা অর্বাচীনতা, লেগাসি বা পরম্পরা বোঝার ক্ষেত্রে তাদের উদাহরণ আসতে পারে বড়োজোর। কিন্তু তারাই ক্রিকেটের বিরাট কুতুব, এটা অন্ধ আরাধনা।

৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় বজায় রাখা অতি অবশ্যই বিরল অর্জন, তবে সেটিও কালোত্তীর্ণ কোনো স্কেল হতে পারে না। সেই সময়ে খেলতো কয়টা দল? বছরে ম্যাচ হতো কয়টা, ক্রিকেটে ফরম্যাটই ছিল মাত্র একটা। এত এত ক্যামেরা, স্পন্সর, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট, টানা খেলার চাপ, ফিক্সিং, রাজনীতি -বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি প্যারামিটারই অনুপস্থিত। তখনকার ব্যাটের চেহারা, পিচ, বোলারদের বোলিং স্টাইল, খেলোয়াড়দের পোশাক, ফিটনেস – সবকিছুই আজকের মানদণ্ডে সম্পূর্ণ অচল। তাদের শৌখিন ক্রিকেটার বলা যেতে পারে, যারা শখের বশে কিংবা এডভাঞ্চারপ্রিয়তা থেকে খেলায় নেমেছে।

কিন্তু ক্রিকেট এখন কোটি কোটি টাকার বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। এর আচার-কায়দাকে আগেকার নিক্তিতে মূল্যায়নভাবনাই খেলো। মানুষ প্রজাতির বিবর্তন ধারায় যেমন হোমো স্যাপিয়েন্স, নিয়ানডার্থাল প্রভৃতি স্পিসিসের ধাপ রয়েছে, জি গ্রেস বা ব্র‍্যাডম্যানরাও ক্রিকেট বিবর্তনের স্পিসিস বলা যেতে পারে।

এমনকি ৩০ বছর পরে টেন্ডুলকারের ১০০ টা সেঞ্চুরিও অপ্রাসঙ্গিক এক রেকর্ডে পরিণত হবে, কারণ বিবর্তিত হতে হতে তখনকার সামাজিক-বৈশ্বিক চাহিদা নতুন চেহারা ধারণ করবে, তখনো টেন্ডুলকারকে টানা মানে তাকে মিথিকাল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা।

এত বেশি বিবর্তন না ঘটলে হয়তোবা যুগের পরিবর্তন সত্ত্বেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতো কিছুটা হলেও।

দর্শক অংশ উহ্য রেখে যদি কেবলমাত্র ক্রিকেটিং স্কিলের জায়গা থেকে দেখি, টেস্ট ক্রিকেটের মূল বক্তব্য টেম্পারমেন্ট, টি-টোয়েন্টি’র ক্ষেত্রে সেটা ইমপ্রোভাইজেশন। ওয়ানডে দুইয়ের মধ্যে একটি ব্রিদিং স্পেস, যেখানে গড়পড়তা টেম্পারমেন্ট আর ইমপ্রোভাইজেশন দিয়েও সাফল্য পাওয়া যায়।

তবে, যদি স্রেফ বলসংখ্যা নিয়ামককে বিবেচনা করি, ১২০ আর ৩০০ এর মধ্যে আহামরি প্রভেদ নেই। সেক্ষেত্রে ১২০ আর ৩০০ এর মাঝামাঝি ২১০ বা ২৪০ বলের ক্রিকেট হয়ে যেতেও পারে। কিংবা টেস্টের মতোই আসতে পারে দুই ইনিংস, যেখানে ২০ ওভারের দু’টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হবে।

১২০ আর ৩০০ বলের বিভাজনটা জরুরী কিনা সেই অনিবার্য প্রশ্ন উঠবেই। তার মানে এটা নয় টি-টোয়েন্টির প্রভাবে ওয়ানডে বাতিল হবে। আদতে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে অভিযোজনের তাগিদেই এই দুই ফরম্যাটের সংমিশ্রণ অনিবার্য যেখানে বলসংখ্যা ১২০ থেকে বাড়বে ৩০০ থেকে কমবে!

টি-টোয়েন্টিকে যারা রেসলিং বলে তারা আদতে কারা? এটা ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’  রোমান্টিসিজমে ভোগা, নাকি ‘সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে গেছে’ হাহাকার করা মানসিকতার মানুষ?

ফ্ল্যাট পিচ, ছোট মাঠ, ভারি ব্যাট—তাচ্ছিল্য করার কী-ওয়ার্ড আরো আছে কয়েকটা। আইসিসির কোনো ইভেন্টেই গত ২৫ বছরে ফ্ল্যাট পিচ দেখেছি মনে পড়ে না। দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে হোম এডভান্টেজ নেয়ার চল তো সুপ্রাচীন। টেস্টে কি মাঠের দৈর্ঘ্য আদৌ ম্যাটার করে? টি২০ তে ৬০-৬৫ মিটার বাউন্ডারিও কি দূষণীয়? টি-টোয়েন্টির যে ভাব আর ভাষা তার সঙ্গে এটা তো সংহতিপূর্ণ। তবু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অধিকাংশ মাঠের বাউন্ডারি এর চাইতে বড়োই রাখা হয়। নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা মিরপুরের মাঠগুলো তো আকৃতিতেই ছোট।

আপনি জানেন মাত্র ১২০টা বল বরাদ্দ পাবেন, এর মধ্যেই যথাসম্ভব রান করতে হবে, পক্ষান্তরে ফিল্ডিং দল ভাবছে রান বাড়তে দেয়া যাবে না। মীমাংসাটা শেষ পর্যন্ত রানেই হচ্ছে। সুতরাং রান করতে অভিনব সব শট রপ্ত করতে হবে আপনাকে। টো-ক্রাশিং ইয়র্কারেও স্কুপ করে চার বা ছক্কার চেষ্টা করতে হবে; যে যত ইমপ্রোভাইজ করবে সে তত স্কিল্ফুল ব্যাটসম্যান।

আপনি ৩০ টা বল খেললে সেখানে ছয়টা বলকে বাউন্ডারি/ওভারবাউন্ডারি, বাকি ২৪ টার মধ্যে ১৮ টাই সিঙ্গেলস নিলে আপনার রান ৪৭-৫০ এর মধ্যে চলে যেতে বাধ্য, স্ট্রাইকরেট ১৫০+, অর্থাৎ ম্যাচের এক চতুর্থাংশ বল যদি আপনি খেলেন সেখান থেকে ৮০% বলকেই রানে রূপান্তরিত কর‍তে হবে, এবং নিজের খেলা ২৫% বলকে বাউন্ডারি বানাতে হবে। এটার জন্য শট রেঞ্জের বিকল্প নেই।

অন্যদিকে টেস্টে উইকেট বাঁচাতে অথবা উইকেট নিতে হবে, রান অনেক পরের ব্যাপার। ২০০ রানের টার্গেটে আপনি ১২০ করলেও ম্যাচ হারেননি যদি অল আউট না হন। এখানে ৫০ বলে ৫০ করার চাইতে ৯০ বলে ৫০ করাটা হয়তবা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে অধিকাংশ সময়, কারণ ওই যে ৪০টা বল বেশি খেললেন তাতে বোলাররা একটু বেশি ক্লান্ত হলো, আপনার দল সেসনটা আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো। এখানে খুব বেশি শট রেঞ্জেরও প্রয়োজন নেই। ডিফেন্সের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে ২-৩টা শট নিয়েও রান করা যাবে, কেবল অপেক্ষায় থাকতে হবে নিজের জোনে বল পাওয়ার।

তবে গত দুই দশকে টেস্টের মেজাজেও বিরাট পরিবর্তন লক্ষণীয়। এগ্রেসিভ খেলে রান বাড়িয়ে নেয়া নীতিতে খেলা শুরুর পরে পাঁচ দিনে গড়ানো ম্যাচের সংখ্যা ব্যাপকমাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।

২০০৭ এর পূর্বে টি-টোয়েন্টি এতটা জনপ্রিয় ছিল না। তবু টেম্পারমেন্ট কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে টি-টোয়েন্টিকে দোষারোপের কারণ কী হতে পারে?

এর সম্ভাব্য কারণ সম্ভবত ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রসার। আইপিএল আর বিগব্যাশ বাইরে যতগুলো ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট হয় কোনটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে? নিকট ভবিষ্যতে পাবেও না, কারণটা অর্থনৈতিক।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যতীত আর কোন দলের ক্রিকেটাররা যত্রতত্র ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছে? দুই মাসের আইপিএল দিয়ে কি দর্শকের মন ভরবে, বা আইপিএল-বিগব্যাশের মহাতারকা যদি জাতীয় দলে সুযোগ না পায় তার তারকখ্যাতি কতটুকু বাড়ানো সম্ভব? আন্দ্রে রাসেল বা সুনীল নারাইন বিশ্বজুড়ে খ্যাপ খেলছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আহামরি কিছু না করার কারণেই ক্রিকেটে তারা বড়ো কোনো নাম নয়।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কি টি-টোয়েন্টি অন্য দুই ফরম্যাটের তুলনায় বেশি মনোযোগ পাচ্ছে? প্রতিটি সিরিজেই টেস্ট অথবা ওয়ানডে থাকবেই। শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টি সিরিজ তো হচ্ছে না সচরাচর। এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা ডেজার্ট ভূমিকাতেই রয়ে গেছে।

আইসিসি গতবছর ২০৩১ পর্যন্ত তাদের ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বাইরে আরো দুটি টুর্নামেন্ট তারা যুক্ত করতে চাইছে, যে ইস্যুতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের সংবাদও এসেছে মিডিয়ায়।

আইসিসি বনাম ফ্র‍্যাঞ্চাইজি দ্বৈরথ কি ঘটতে পারে ভবিষ্যতে? আইপিএল বর্তমানে যত বড়ো হয়েছে, এর চাইতে বাড়ার আর সুযোগ নেই নানা কারণেই৷ পাকিস্তানের কোনো ক্রিকেটার আইপিএল এ সুযোগ পায় না, একাদশে বিদেশী সুযোগ পায় ৪ জন; ভবিষ্যতে দল সংখ্যা বেড়ে যদি ১০-১২ হয় এবং ৫-৬ জন বিদেশি খেলতে পারে, তবু তো সেটা একটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টের বেশি কিছু নয়।

ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগ পর্যায়ে কি তা উন্নীত হওয়া সম্ভব? ক্রিকেটের কালচারের সঙ্গেই তা বেমানান, কারণ ক্রিকেটে জাত্যাভিমান বিষয়টি এশিয়ান দেশগুলোতে এত বেশি প্রকট এবং ফুটবলে তারা এতটাই পিছিয়ে যে, ক্রিকেট ছাড়া তাদের মুক্তি নেই। কারণ স্পোর্টসের আবেদন অন্যরকম। কম্পিউটার গেমস যতোই জনপ্রিয়তা পাক, মানবিক সংস্পর্শ আরো অন্তত ৩০-৪০ বছর এই অঞ্চলে প্রাসঙ্গিক থাকবেই।

আইসিসি যদি বিলুপ্ত না হয় ক্রিকেটে নানা মাত্রা যুক্ত হতেই থাকবে। এক্সপেরিমেন্ট থামারও কারণ দেখি না। টেস্ট নিয়ে সুযোগটা কম। কারণ করোনা পরবর্তীতে পৃথিবীতে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে কড়াকড়ি বাড়বে। এ কয়মাসেই বায়ো-বাবল মেনে সিরিজ চালাতে বোর্ডগুলো আর্থিকভাবে যেরকম হিমশিম খাচ্ছে, এভাবে ৫-৬টা সিরিজ চালালেই বিকল্প ভাবতে হবে।

এবং সঙ্গত কারণে সময়ই হবে প্রধান প্রতিবন্ধক। একটা টেস্ট সিরিজ চালাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হবে, তুলনায় উপার্জন কম। তাছাড়া বায়োবাবলে থাকতে থাকতে ক্রিকেটারদেরও মেন্টাল হেলথ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মরগান, হোল্ডার, ওয়ার্নারসহ পরিচিত অনেক ক্রিকেটারই আশংকা করছে অবসর নেয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যেকারণে যে কোনো সিরিজ থেকে ১-২টা টেস্ট ছেঁটে ফেলে অপটিমাইজেশনের ঘটনা ঘটতেই পারে। এমনকি টেস্টের দৈর্ঘ্য নেমে আসতে পারে ৪ দিনেও।

বিশুদ্ধ ক্রিকেটবাদীতাকে কি এক ধরনের ইলিউশন বলা যায়?

টেম্পারমেন্ট আর ইমপ্রোভাইজেশনের মধ্যে কোনটিকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তার ভিত্তিতেই আদতে বিশুদ্ধতা নিরূপিত হবে। স্রেফ প্রাচীনতার নিয়ামকে টেস্টকে বিশুদ্ধ ভাবা, এটা ক্রিকেট কোচদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে, দর্শক বা নন-ক্রিকেটিয় কোনো ব্যক্তির নয়। কারণ যে কিশোরটি ক্রিকেট খেলেই উপার্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই ৫দিন মাঠে থাকার ফিটনেস রাখতে হবে, ৫০০ বল ব্যাটিং করার টেম্পারমেন্ট, দিনে ২৫ ওভার বোলিং করার সামর্থ্য, সঙ্গে বৈচিত্র‍্য আনতে হবে।

কিন্তু এমনও হতেই পারে একজন ক্রিকেটার স্বপ্নই দেখলো সে ইমপ্রোভাইজেশন শিখেই ক্রিকেটার হবে, তবু তাকে টেম্পারমেন্ট দিয়েই শুরু করতে হবে। কারণ টেম্পারমেন্ট তৈরি না হলে ইমপ্রোভাইজেশনেও সে দুর্বল হবে। পরবর্তীতে হয়তোবা সে শুধু ইমপ্রোভাইজেশনেই ফোকাস করলো।

কিন্তু, একজন দর্শকের সেই সব শর্তের বালাই নেই। টি-টোয়েন্টিতে প্রায় প্রতি ওভারে ম্যাচের মোমেন্টাম বদল হয়।

বাঘের অসংখ্য প্রজাতি হতে পারে। কোন বাঘ আসল তা নিয়ে বিতর্ক যেমন অবান্তর, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই নয় টেস্টই আসল, এটাও সেই ধরনের মানসিকতা। কিংবা থিয়েটারে অভিনয় আর সিনেমায় অভিনয় সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। অভিনয়ের আসল জায়গা হলো মঞ্চ, সিনেমাওয়ালারা অভিনয় জানে না – এ ধরনের দ্বৈরথ বহু আগে থেকেই ছিল সমাজে। পরিবর্তনকে স্বাগত না জানানো সমস্যা নয়, তবে পত্রপাঠ খারিজ করে দেয়াও যে নিজস্ব কমফোর্টকে আকড়ে ধরে যে কোনোভাবে জিততে চাওয়া – এটা চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সংকট।

ক্রিটিকাল থিংকিংয়ে আগ্রহী মানুষদের বৃহত্তম অংশই যে ক্রিকেটে অনাগ্রহী এর মূল কারণ কিন্তু সময়। নইলে এই খেলায় সংখ্যার যে বহুল ব্যবহার, ব্যাটসম্যান-বোলার-ফিল্ডারের যে শৈল্পিক কম্পোজিশন, মাত্র ২২ গজ দূরত্ব থেকে ৮০ মাইল গতিতে বল ছুড়ে দেয়া এবং স্রেফ রিফ্লেক্সের বশে সেটা ডানে-বায়ে পাঠানো – সমগ্র ব্যাপারটাই একই সঙ্গে সার্কাস/মার্শাল আর্টের মতো কঠোর পারফর্মিং আর্ট, এবং ফিল্মের মতো দুর্দান্ত ভিজুয়াল আর্ট – এর মধ্যে পর্যবেক্ষণের বহু উপকরণ উপস্থিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link