কুম্বলের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত দিল্লী

রৌদ্রজ্জ্বল এক রবিবার। ছুটির দিনের আবহাওয়া রাজধানী দিল্লীতে। ভারত একটি জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছে। বিশাল এক টার্গেট ছুড়ে দেওয়া গেছে  চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের দিকে। চতুর্থ ইনিংস সেই সাথে টেস্টের চতুর্থ দিন। নিদারুণ কঠিন একটা পথ পাড়ি দিতে হবে পাকিস্তানকে। ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দিনটি অবশ্য পাকিস্তানের হয়নি। হয়েছিল এক অতি মানবীয় স্পিন জাদুকরের।

৪২০ রানের বিশাল এক টার্গেটে পাকিস্তানের পক্ষে চতুর্থ ইনিংসে উদ্বোধনী দুই ব্যাটার সাঈদ আনোয়ার ও শহীদ আফ্রিদি। বিশাল লক্ষ্য। হাতে যদিও সময় আছে তবুও শেষের দুইদিন খেলা ঘুরে যেতে সেশন নয় স্রেফ একটি ওভারই যথেষ্ট। এই বিষয়টি নিশ্চয়ই মাথায় ছিল আনোয়ার ও আফ্রিদির। তাইতো বাইশ গজে নেমেই মারমুখি পাকিস্তানের এই দুই ব্যাটার। দ্রুত গতিতে ব্যাট চালিয়ে দলীয় সংগ্রহ ছাড়িয়ে গেছে একশো রানের গণ্ডি।

জয়ের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছিল পাকিস্তান। অবশ্য ভারতের বিপক্ষে সে সময়টায় দাপটই দেখাত পাকিস্তান। আরও একটি জয় তখন তাদের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তানের দুই ব্যাটারকে থামানোর কোন উপায়ই যেন জানা নেই ভারতের কোন বোলারদের। দিশেহারা গোটা ভারত দল। তবে নাবিকহীন হয়নি তাঁরা। দক্ষ নাবিক হয়েই ভারতের তরী বন্দর অবধি নিয়ে গেছেন অনিল কুম্বলে।

সেদিন বোধহয় মহাজাগতিক সকল শক্তির সঞ্চার ঘটেছিল কুম্বলের সেই ডানহাতের কব্জিতে। সেখান থেকে এল সব অপ্রতিরোধ্য সব ঘূর্ণি। টর্নেডোর মত করে যা উড়িয়ে নিয়ে গেল পাকিস্তানকে। জয়ের আশায় বোনা ফসলের উপর দিয়ে স্টিম রোলার চালিয়ে দিলেন কুম্বলে একাই। টপাটপ সব ক’টি উইকেট কুম্বলের পকেটে। মাত্র ১৮.২ ওভার চালানো তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড করে দিল সব।

শুরুটা তিনি করেন শহীদ আফ্রিদির উইকেট নিয়ে। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল এক্সট্রা কাভার অঞ্চলের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা করেন আফ্রিদি। তবে জাদু মিশ্রিত সেই ঘূর্ণিটা ঠিক ধরতে পারেননি তরুণ আফ্রিদি। ব্যাটের সাথে কিঞ্চিৎ সংযোগ ঘটিয়ে বল গিয়ে জমা পড়ে উইকেটরক্ষক নয়ন মঙ্গিয়ার দস্তানায়। আম্পায়ারের তর্জনী তখন বাতাসে।

১০১ রানের মাথায় পাকিস্তানের প্রথম উইকেটের পতন। আর ঠিক সেখান থেকেই শুরু এক রুপকথার। আপন মহিমায় যে রুপকথার প্রতিটা পাতা সাজিয়েছেন কুম্বলে। রোমাঞ্চকর সব গল্পের মিশ্রণ ঘটিয়ে ইতিহাস নন্দিত এক রুপকথা। ওই যে শুরু এরপর থেকে কুম্বলে রীতিমত এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। দখল করেছেন দিল্লির মসনদ।

আফ্রিদিকে ফেরানোর পর ঠিক এরপরের বলেই তিনি ফেরান ইজাজ আহমেদকে। দারুণ এক ফ্লিপার। আঘাত হানে প্যাডে। মিডল স্ট্যাম্প লাইনে থাকা বলটা নির্ঘাত স্ট্যাম্পে উপড়ে ফেলার কথা। তাইতো আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ইজাজ আহমেদ প্যাভিলিয়নের পথে। হ্যাট্রিক করবার সুবর্ণ সুযোগ তখন। তবে সে যাত্রায় তা হয়ে ওঠেনি। ২৮ তম ওভারের শেষ বলটায় ইনসাইড এডজে আউট হন ইনজামাম-উল হক। বল ঠিক পড়তে পারেননি তিনি। মুহূর্তের মধ্যে ম্যাচের পাল্লা হেলে পড়তে শুরু করে ভারতের পক্ষে।

তখনও বেশ লম্বা একটা পথ পাড়ি দিতে হবে পাকিস্তানকে। তবে তাদের অবশ্য নিস্তার দেননি কুম্বলে। ইনিংসের ৩৭ ও ৩৯ তম ওভারে যথাক্রমে মঈন খান ও আনোয়ারের উইকেট তুলে নেন কুম্বলে। পাকিস্তানের অর্ধেক তখন সাজঘরে। দারুণ এক উৎকণ্ঠা তখন ছড়িয়ে যায় পাকিস্তানের শিবিরে। এর আগে অবশ্য লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেছিলেন তিনি মোহাম্মদ ইউসুফকে।

অর্ধেক ব্যাটিং লাইনআপ যখন ড্রেসিং রুমে তখন জয় কেবলই এক খোয়াব। সেদিন অবশ্য কুম্বলের ওমন রুদ্রমূর্তি ধারণের সহয়তা করেছিল তাঁর সতীর্থরা। মঈন খানের ক্যাচটা স্লিপ কর্ডোনে লুফে নিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। যেকোন সাধারণ দিনে সেই ক্যাচ হাত থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই অত্যন্ত বেশি। দলগত নৈপুণ্য যে একেবারেই ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে সব ছাপিয়ে দিনটা ছিল কেবলই কুম্বলের।

বাকিটা সময়ের কালক্ষেপন হয়েছেন স্রেফ। রেকর্ড থেকে দূরে রাখা যায়নি। ইতিহাসের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েন অনিল কুম্বলে। আপাদমস্তক সব ক’টি উইকেট তাঁর আগে নিয়েছিলেন জিম লেকার। কিংবদন্তিদের পাশে তো কিংবদন্তিদেরই মানায়। বছর ঘুরে প্রতি বছরই রোমন্থন করবার মত এক স্মৃতি হয়ে নিশ্চয়ই কুম্বলের মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরে বেড়ায় সেদিনের দিল্লি।

সেই টেস্ট ম্যাচটা অবশ্য বেশ একটা লম্বা সময় বাদে ভারতের জয় ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে নব্বই দশকে ভারতের টেস্ট জয় রীতিমত পাহাড় চড়ার সমান। তাও আবার এভারেস্ট। দিল্লি টেস্ট জিতলেও সেবার ঘরের মাঠে সিরিজ হারতে হয়েছিল ভারতকে। যদিও সবকিছুই আড়াল হয়ে যায় কুম্বলের সেই রেকর্ডের রোশনাইতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link