২০০৮ সিবি সিরিজ: শচীন কী স্বার্থপর ছিলেন?

একটা জিনিস কেউ লক্ষ্য করছেন কিনা জানি না, বিরাট কোহলিও বেশ কিছুদিন ধরে কিন্তু শিট অ্যাঙ্কর বা সেকেন্ড ফিডল প্লে করছেন। প্রতিটা পার্টনারশিপে তাঁর পার্টনার তার থেকে দ্রুত এবং বেশি রান তুলছেন, এবং কোহলিকে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিব্রত দেখা যাচ্ছে না। কেননা অন্যদিকে কখনো সূর্য, কখনো হার্দিক, কখনো ডিকে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছেন। আমার মনে হয় দলের স্ট্র্যাটেজিও সেটাই। কোহলি একটা দিক ধরে রাখবেন, অন্যদিকে অন্যেরা মারবেন। দলের জয়টাই আসল।

আজ থেকে দশ পনেরো বছর বাদে যদি কেউ এই সব ম্যাচের স্কোরবোর্ড স্ট্যাট খুলে গ্রাফ প্লট করে বসেন, মনে হতেই পারে কোহলি নিজের স্বার্থে খেলছিলেন, স্লো খেলছিলেন, দলের কথা ভাবছিলেন না।
এই যে আজকে চোখের সামনে বল বাই বল ম্যাচটা দেখছি, এর কোনো বিকল্প কোনো স্ট্যাটিসটিক্স বা স্কোরবোর্ড বা এমন কি হাইলাইটস ও দিতে পারবে না।

কোহলি যে শেষ ওভারে ডিকেকে পরিষ্কার বললেন যে আমার হাফ সেঞ্চুরির কথা ভাবতে হবে না, তুই মার, যতো বেশি রান হয় সেটাই ভালো দলের জন্য, সেই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিভিতে পরিষ্কার দেখলাম। সেটাও কোনো স্কোরবোর্ডে ধরা পড়বে না।

এবারে আসল প্রসঙ্গে আসি, যার জন্য আপনারা সবাই অপেক্ষা করছেন! ২০০৮ সালের সিবি সিরিজের দুটো ফাইনালে শচীন টেন্ডুলকার যথাক্রমে ১১৭* এবং ৯১ রান করেন। ১৪-১৫ বছর আগের দুটি ম্যাচের শুধু স্কোরবোর্ড, স্ট্রাইক রেট ইত্যাদি যখন গ্রাফে প্লট করা হলো, দেখা গেলো শচীনের স্ট্রাইক রেট প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরির আগে ড্রপ করেছে। অনেকের মনে ধারণা জন্মালো শচীন তো এরকম করেই থাকেন, গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই! কমেন্ট বক্সে বন্যার মত – ‘শচীন ভক্তরা কোথায় মুখ লুকোবে?’ ‘স্বার্থপর ক্রিকেটার’ ইত্যাদি। এরপরে নার্ভাস নাইন্টি যখন প্লট করা হলো, পরের ফাইনালের ৯১ সেখানে এলো। ‘শচীনের কবরে পেরেক পুঁতে দিয়েছো ভাই’ ( nailed it bro) ইত্যাদির বন্যা।

এবারে একটু পিছিয়ে যাই, নব্বইয়ের দশকের শুরু বা মাঝামাঝি। শচীনের একটিও ওয়ান ডে সেঞ্চুরি নেই যখন, কিন্তু বেশ কিছু ম্যাচ জেতানো ৭০/৮০ আছে, তখন রিপোর্টার, বিশেষজ্ঞ, গাভাস্কার ( গাভাস্কারের ক্রিকেট প্রজ্ঞা যেহেতু আলাদা লেভেলের, ওকে আমি আলাদা একটা ক্যাটাগরিতে ফেলি, আর শচীন ও গাভাস্কারকে খুব মান্য করতেন) এঁরা সমালোচনা শুরু করেছিলেন যে শচীন সেঞ্চুরির কাছে এসে হঠকারী শট খেলছেন, হাতের সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে আসছেন। না আপনার মনে নেই হয়তো, আপনি হয়তো জন্মাননি, বা খেলা দেখা শুরু করেন নি।

চাপ নেবেন না, হাতে গরম উদাহরণ শুভমন গিল আর ঋষাভ পান্ত। গিল অনেকদিন ৮০/৯০ এর ঘরে আউট হবার পরে প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন। পন্থ টেস্ট ওয়ান ডে মিলিয়ে বেশ কয়েকটা সেঞ্চুরি করলেও, হঠকারী শট খেলে সেট হয়ে অনেকবার আউট হয়েছেন। আমি কিন্তু একজনকেও দেখছি না বলতে যে ‘আহা, নিজের রেকর্ডের কথা না ভেবে দলের জন্যে খেলছিল!’ সমালোচনাই শুনছি। (ঠিক যেমন হর্ষ ভোগলের মাথায় চুল না থাকার সময় কেউ তাঁকে বলেননি যে আপনাকে ভালই দেখায়।

চুলের ট্রিটমেন্ট করার পরে অনেকেই বলেছিল, ঠিক তেমনি)। ইয়েস, জনগন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শচীনের সম্পর্কে এটাই হয়েছিল। কেনো তিনি হুক মেরেই যাচ্ছেন, এই শট বার বার তাঁর পতনের কারণ হচ্ছে দেখেও? কেনো তিনি ম্যাচ জিতিয়ে আসতে পারছেন না! ইয়েস, ম্যাচ জিতিয়ে আসা, এটা শচীনের সম্পর্কে যতবার ব্যবহার হয়েছে, আর কোনো ওপেনিং ব্যাটসম্যান সম্পর্কে ব্যবহার হয়েছে বলে আপনার মনে পড়ছে স্ট্যাট বিশেষজ্ঞ? মার্ক ওয়া, গিলক্রিস্ট, হেইডেন, গিবস, জয়াসূরিয়া, আনোয়ার, কারুর প্রতি দাবি করা হয়েছে যে কেনো ম্যাচ ফিনিশ করে আসছেন না?

শচীনের প্রতি হয়েছে, কেননা তিনি সেই সময়ে ওয়ান ম্যান আর্মি ছিলেন, এবং যখন ছিলেন না, তখনও দর্শকের দাবি ও বিশেষজ্ঞদের ( হয়তো আপনারও) প্রত্যাশা সেটাই ছিল। চেন্নাই টেস্ট থেকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০ তাড়া করে ১৭৫, যখনই আউট হয়েছেন, তাঁর অসাধারণ ইনিংস ছেড়ে কাটাছেঁড়া হয়েছে কেনো তিনি জিতিয়ে আসতে পারেন নি? বাকি দশজনের কথা ছাড়ুন, শচীন কেনো সেট হয়েও আউট হবেন?

এই অপবাদ গুলোই শচীন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষদিকে মেরামত করার চেষ্টা করছিলেন। ২০০৮ সালে চেন্নাইতে ১০৩* করে ম্যাচ জেতালেন, হ্যাঁ, সহায়তা পেয়েছিলেন শেবাগ আর যুবরাজের। সিবি সিরিজের প্রথম ফাইনালে ৮৭ রানে তিন উইকেট পড়ার পরে নবাগত রোহিত শর্মার সাথে জুটি বেঁধে দলকে জয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তার পরে ব্যাটিং বলতে ধোনি, প্রবীণ কুমার, পাঠান, হরভজন। অস্ট্রেলিয়া যত কমজোরি হোক, অস্ট্রেলিয়া, নিজের ঘরের মাঠে খেলছে। একবার রক্তের গন্ধ পেলে শেষ ৭ উইকেট ৫০ রানেও যে ফেলে দিতে পারে সেই উদাহরণ ভারতের ঘরের মাঠেই বছর কয়েক আগেই আছে।

এই সময়ে শচীন কি করবেন? গ্লোরি শট খেলে আউট হয়ে আপনাকে আরেকবার শচীন ফাইনালে ব্যর্থ, ম্যাচ জিতিয়ে আসতে ব্যর্থ বলার সুযোগ দেবেন? নাকি আস্কিং রেট কন্ট্রোলে আছে দেখে ম্যাচ জিতিয়ে আসবেন? আপনার বৃহৎ আর আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কি বলে? শচীন সেটাই করেছিলেন যেটা তাঁর কাছে দল চেয়েছিল। ও হ্যাঁ, যেনতেন প্রকারেন শচীনকে সেঞ্চুরি না করতে দেবার জন্যে শচীনকে ৯০ এর ঘরে থাকাকালীন ১৫০ কিমির বিমার দিয়ে কাঁধে আঘাত করেন ব্রেট লি (হ্যাঁ, সেটা অনিচ্ছাকৃত ছিল, এটাই ধরে নিতে হবে, কিন্তু বীমার টা বীমার ই )।

একটাও গালাগালি না দিয়ে হাসিমুখে ব্রেট লির সাথে হ্যান্ডশেক করে পরের বল খেলতে প্রস্তুত হন শচীন। হ্যাঁ, মশাই এটা স্কোরবোর্ডে পাবেন না। ভারত ফাইনালটা জিতেছিল। শচীনের স্লো খেলার জন্য হারেনি কিন্তু। বহু বছর বাদে কুড়িটা ম্যাচের স্ট্যাট নিয়ে যখন বসবেন, দেখবেন ছটা ম্যাচে স্লো খেলেছেন, ৯ টা ম্যাচে হেরেছে দল। আপনি অতি সরলীকরণ করবেন, যেগুলোয় স্লো খেলেছে সেগুলোতেই নিশ্চয়ই দল হেরেছে, শচীন স্বার্থপর, নিজের সেঞ্চুরির লোভে রেকর্ডের জন্য খেলতেন। আপনি মিস করে যাবেন এইসব ম্যাচ, যেখানে উইকেটে টিকে থেকে জিতিয়ে আসা বেশি দরকারি, পিটিয়ে ছাতু করার থেকে।

পরের ফাইনালে ভারত আগে ব্যাট করে। সেখানে শচীন কিন্তু সেঞ্চুরির কথা ভেবে স্লো খেলেননি। দলের স্কোর বাড়ানোর জন্য ইম্প্রভাইজ করতে গিয়ে আউট হন। হ্যাঁ, নার্ভাস নাইন্টি। আপনি সেটাই বলবেন। এখানে কিন্তু শচীন দলের কথা ভেবে মারতে গেছেন বলবেন না। এটাই হচ্ছে শুধু স্ট্যাট দেখার অসুবিধে।

ম্যাচের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এই দুটো ফাইনাল থেকে শচীনের ইনিংস দুটো সরিয়ে দিন। কি মনে হয়? ধোনির যুব ভারত, সৌরভকে ফিল্ডিং এর দুর্বল ইত্যাদি বলে বাদ দেওয়ার পরের দল এই সেই সময়ে একটাও ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়ুন, সেঞ্চুরি না করা রোহিত, ধারাবাহিক নন এমন উথাপ্পা, দুটি ফাইনালের একটাতেও রান না পাওয়া গম্ভীর, প্রবীণ কুমার, ধোনি আর একমাত্র ফর্মে থাকা যুবরাজ কে দিয়ে জিতে যেত?

ওই দুটো ইনিংস আজ অবধি ভারতের একমাত্র অস্ট্রেলিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে হারিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের চাবিকাঠি হয়ে থেকে গেছে। সেঞ্চুরির আগে স্লো খেলেছেন? নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন? বেশ করেছেন। এরকম টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য আরো দশবার করতে হলে দশবারই করতেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link