গতকাল রাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড বাংলাদেশ সফরের দল ঘোষণা করেছে।
দল ঘোষণা করার পর দেখা গেছে, প্রথম সারির অনেক ক্রিকেটারের নামই সেই দলটাতে নেই। কারণ হিসেবে জানা গেছে, কোভিড সতর্কতায় তারা তাদের নাম সরিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারটি অবশ্য খুব বেশি সত্যি নয়। বিগ ব্যাশে খেলছেন গোটা কয়েক উইন্ডিজ ক্রিকেটার। সামনেই টি-টেনেও খেলবে অনেকে। মূলত, এই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রতি প্রলুব্ধ হওয়াই তাদের এই দলে না থাকার কারণ।
যা হোক, তাতে কিছুই যায় আসেনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা এসব করেই থাকেন। সেসব নিয়ে লিখতেও বসিনি। গতকাল যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ঘোষণা করল, বাংলাদেশি সমর্থকদের একাংশ ভেবে নিয়েছেন এই দুর্বল দল আসাতে আমরা এবার ম্যাচটা জিতব। কেউ কেউ অবশ্য এই দুর্বল দলের সাথে জেতাতে নাকও সিঁটকাচ্ছেন!
দেখুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুর্বল দল নিয়ে খেলবে নাকি শক্তিশালী দল নিয়ে খেলবে তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিছুই যায় আসেনা। সাদা চোখে বাংলাদেশ খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা কেমন হবে, সেটা একান্তই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের নিজস্ব ব্যাপার। তাই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দলটার সাথে ম্যাচ জিতলে আমরা মহাপাপ যেমন করে ফেলব না, দিগ্বিজয়ীও হয়ে যাব না।
এখন, আমরা যে এই দলটাকে দেখেই বলছি আমাদের জন্যে এটা জয়ের ‘সুযোগ’, কিন্তু যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেসন হোল্ডারের নেতৃত্বে পূর্ণ শক্তির দল নিয়েও আসত তাহলেও কি আমরা ম্যাচ জিততাম না?
উত্তরটা আমি দেব না, দেবে পরিসংখ্যান!
বাংলাদেশ সফরে শেষবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিল ২০১৮ সালের নভেম্বরে। সেই সফরে দুটো টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই দলটা কিন্তু মোটেও এখনকার এই দলটার মত দুর্বল ছিল না। শাই হোপ, শিমরন হেটমেয়ার, কেমার রোচ, কিমো পল, শ্যানন গ্যাব্রিয়েলে সাজানো দলটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই সময়ের ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে সেরা স্কোয়াড’। তা সেই দলটার সাথে আমাদের ফলাফল ছিল- দুটো টেস্ট ম্যাচের দুটোতেই জয়।
ক্রিকেটে অনেক সময়ই জয়ের চেয়ে প্রভাব খাটিয়ে জয় অনেক বড় হেডলাইন হয়ে আসে। আমাদের জয় দুটোও ছিল ওরকম প্রভাব খাটানো জয়। প্রথম টেস্ট ম্যাচটাতে আমরা জিতেছিলাম ৬৪ রানে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলআউট হয়েছিল মাত্র ১৩৯ রানে, একই ম্যাচে বাংলাদেশের দু’জন স্পিনার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন- নাঈম হাসান প্রথম ইনিংসে, তাইজুল ইসলাম দ্বিতীয় ইনিংসে।
দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে আমাদের প্রভাব ছিল আরো বেশি। প্রথম ইনিংসে আমরা করেছিলাম ৫০৮ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলোঅনে পড়ে দুই ইনিংস মিলিয়েও আমাদের প্রথম ইনিংসের সমান রান তুলতে পারেনি। এক ম্যাচে একাই ১২ উইকেট নিয়ে (প্রথম ইনিংসে ৭, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ টি) মেহেদী মিরাজ একাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটাকে গুটিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ জিতে গিয়েছিল ইনিংস ব্যাবধানে।
ওয়ানডে ফরম্যাটে ফিরলে সে সফরে আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিলাম ২-১ ব্যাবধানে। হোম সিরিজ বলে যদি ভেবে থাকেন, আমরা একটু সুবিধাজনক অবস্থাতে থেকে সিরিজ জিতেছি তাহলে জেনে রাখুন, ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে আমরা ওদের মাটিতেই ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিলাম, সেটাও ২-১ ব্যাবধানে।
শুধু কি তাই, বিশ্বকাপের আগে আগে যে ট্রাই নেশন্স সিরিজটা হল আয়ারল্যান্ডে সেখানেও আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে তিনটে ম্যাচ খেলেছি। সেই তিনটে ম্যাচের তিনটেতেই আমরা জিতেছি। শুধু তাই নয়, ফাইনাল ম্যাচটাতে তো আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েই ট্রাই নেশন্স কাপের ট্রফি জিতলাম। যেটা কিনা বহুজাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রথম ও একমাত্র ট্রফি।
ফাইনাল ম্যাচের গল্প বলতে গিয়ে মনে পড়ল, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের তুলনায় যে একটু হলেও এগিয়ে থাকা দল তার উদাহরণ দিতে এই ম্যাচটার কিছু ব্যাপার তুলে ধরা যায়। ডাবলিনের সেই ম্যাচটাতে ছিল বৃষ্টির বাগড়া। ২৪ ওভার ব্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্কোরবোর্ডে তুলেছিল ১৫২ রান, ১ উইকেট হারিয়ে। ২৪ ওভারে ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়িয়েছিল ২১০। তা বাংলাদেশ সেই ম্যাচ জিতেছিল ২২.৫ ওভারেই, ২১৩ রান তুলে!
সেই সিরিজের পর ছিল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি হয়েছিল। আর যেহেতু এটা ছিল বিশ্বকাপ, ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের সেরা দলটা নিয়েই খেলতে এসেছিল তা তো বলাই বাহুল্য। সেই দলটার সাথেও আমরা জিতেছিলাম। সেই জয়টা কিভাবে আসল এবার তাহলে সেটা বলি। ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৩২১ রান। ৩২২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ সে ম্যাচটা জিতেছিল মাত্র ৪১ ওভার ৩ বলেই, তিন উইকেট হাতে রেখে!
একটা দল যখন ১০ ওভার আগেই ৩২২ রান চেজ করে একটা দলের বিপক্ষে বিশ্বকাপ মঞ্চে ম্যাচ জিতে যায়, সেই দলটা মানদন্ডে অপর দলটার চাইতে কতটা ভাল সেটা কি নতুন করে প্রমাণ করার আছে?
নাহ, নেই। আর তাই একটা ব্যাপার খুবই পরিষ্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁদের সবচাইতে সবল দলটা নিয়ে এলেও আমরা এই সিরিজে পরিষ্কার ফেভারিট ছিলাম। এখন যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুর্বল দল নিয়ে আসছে, তখনও আমরা এই সিরিজটাতে পরিষ্কার ফেভারিট। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেমন দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছে, তাতে মনে হয় তাই আমাদের কিছুই আসা যাওয়া উচিত না।
তবে, আমাদের পা ও মাটিতে রাখা জরুরী। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুর্বল দল নিয়ে এলেই আমরা ম্যাচ শুরুর আগেই জিতে যাওয়ার কোন কারণ নেই। পঁচা শামুকে পা কাটার অভ্যাস আমাদের পুরোনো, তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে একটু বেশি।
২০১৪ সালে ভারত আমাদের দেশে এসেছিল মোটামুটি দ্বিতীয় (নাকি তৃতীয়?) সারির একটা দল নিয়ে। ফ্রন্টলাইন কোন বোলার ছাড়াই একটা ক্রিকেট বোর্ড যে দল ঘোষণা করতে পারে তা সেই সিরিজে দেখা গেছিল। সেবারও মনে হচ্ছিল, আমরা বুঝি জিতেই গেলাম! কিন্তু শেষে কি হল? অখ্যাত এক স্টুয়ার্ট বিনি আমাদের গোটা ব্যাটিংলাইনআপ দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দিল। নিয়মিত কোন বোলার ছাড়াই গড়ে তোলা সেই ভারতীয় বোলিং লাইনআপ এর সামনে আমরা এতটাই অসহায় হয়ে পড়লাম যে মাত্র ৫৮ রানে অলআউট হয়ে গেলাম।
আবার গেল আফগানিস্তান টেস্টটার কথাই ধরা যাক। সবেমাত্র টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া একটা দল যখন আমাদের দেশে এল, আমরা জয় ছাড়া কিছুই ভাবিনি। টিম ম্যানেজমেন্টের আত্মবিশ্বাস তো এতটাই বেশি ছিল যে আফগানিস্তানের সাথেও আমরা স্পিন উইকেট নিয়ে খেলতে নামলাম। তাতে যা হল, আফগানিস্তানের স্পিন ঘূর্ণিতে আমাদের টেস্ট ম্যাচটাই হারতে হল।
সবেমাত্র টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া একটা দলের কাছে হেরে গেলাম ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে টেস্ট খেলা আমরা!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দলটাকেও তাই হেসে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই, আবার কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার কিছু নেই, এমনকি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করারও কিছু নেই, ম্যাচ জিতলে নাক সিটকানোরও কিছু নেই। বাংলাদেশকে শুধু স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে হবে, তাহলেই নিশ্চিত জয় দেখব আমরা!
আরেকটা কথা মাথায় রাখা জরুরী, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই দুটো ম্যাচ জিতে আমরা কি পয়েন্ট টেবিলে ওপরে চলে যাব? ফাইনাল খেলব? নাহ! বাংলাদেশের তাই এদিকে মনোযোগ না দিলেও চলবে। বাংলাদেশের মনোযোগ দিতে হবে, টেস্টে উন্নতি করার দিকে, খেলাতে আরো ভাল কিভাবে করা যায় সেদিকে! তাহলেই সিরিজটার মূল উদ্দেশ্য সাধিত হবে!