একটা গুঞ্জন প্রবল ছিল। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মত নাকি দল থেকে বাদ পড়া কিংবা বিশ্রাম পাওয়াদের তালিকায় রয়েছেন মুশফিকুর রহিম। অবশ্য পরিসংখ্যান ঘেটে দেখলে সে কথার খানিকটা জোর পাওয়ারই কথা। গেল প্রায় একটা বছর ধরেই নিজের ছায়া হয়েছিলেন মুশফিক। মিস্টার ডিপেন্ডেবল তকমাটার যথার্থতাই যেন প্রমাণ করতে পারছিলেন না।
২০২২ এর পুরোটা জুড়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে মোটে ২৩০ রান করেছিলেন তিনি ২৩ গড়ে। অভিজ্ঞতা বা সক্ষমতা এসব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করবার উপায় নেই। মুশফিক লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিচরণ করছেন। তাছাড়া তিনি সময়ে সময়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন দলের জন্য। তাইতো তাঁর ছন্দপতন বেশ চোখে লাগে।
আবার বয়স একটা ফ্যাক্টর ছিল। তাছাড়া ফরম্যাটের ভেদাভেদ ভুলে সবাই মুশফিককে বিচার করা শুরু করে তাঁর টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যানকে ঘিরে। সেই ফরম্যাটটা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। আর এবার ওয়ানডেতে তিনি ছেড়েছেন নিজের পছন্দের চার নম্বর ব্যাটিং পজিশন। তবে সেটা হয়ত দলের পরিকল্পনারই অংশ। আর তাতেই ভয়াবহ সাফল্যের দেখা যেন আবার পেতে শুরু করেছেন মুশফিকুর রহিম।
আর মুশফিকের সেই রুদ্রমূর্তিতে রীতিমত ভষ্ম হয়ে গেল গোটা আয়ারল্যান্ড দল। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মুশফিকের ব্যাটিং ডিমোশন দেখে শঙ্কিত হওয়া সবাই শেষমেশ হয়েছিলেন পুলকিত। কি দুর্দান্ত এক ইনিংসই খেললেন তিনি! প্রায় ১৭০ স্ট্রাইকরেটে ৪৪ রানের ছোট্ট ক্যামিও। আর তাতেই শক্ত ভীতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সংগ্রহটা পায় বাড়তি তাড়না। বাংলাদেশ গড়ে ফেলে নিজেদের রেকর্ড।
অল্পের জন্য অর্ধশতক না পাওয়ার আক্ষেপটা নিশ্চয়ই মুশফিকের ছিল। আর সেই আক্ষেপ নিয়ে শেষ করা ইনিংসটি যেন মুশফিকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুনে জ্বালানির যোগান দেয়। তাতেই মিস্টার ডিপেন্ডেবল যেন ছুটে চলেন নিজের দূর্বার গতিতে। তাঁর আগ্রাসনের যেন কোন জবাবই দেওয়ার নেই আইরিশদের। বল পিচ করেছে আর মুহূর্তেই তা বাউন্ডারি ছাড়া হয়েছে। দেখে শুনে খেলার যেন কোন বালাই নেই। ঝুঁকিপূর্ণ শটও মুশফিক খেলেছেন অবলীলায়।
পথিমধ্যে তিনি তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ৭০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করে ফেলেন। আর ঠিক এরপর তিনি তুলে ফেলেন নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের নবম সেঞ্চুরি। গ্রাহাম হিউমের ইনিংসের শেষ বলে তিনি পৌঁছে যান তিন অংকের সেই ম্যাজিক্যাল ফিগারে।
প্রায় বছর দুই বাদে আবারও তাঁর ব্যাট থেকে শতকের স্ফুরণ। তবে ১৭ ম্যাচ পরে মুশফিকের শতকে মোড়া এই ইনিংসটি একটু ভিন্ন। শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পথে এই ইনিংসগুলো মুশফিকের অনুপ্রেরণা। সামনেই ভারতের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই দলের পক্ষে তিনি আবারও নিজের ডিপেন্ডেবল সত্ত্বায় আবির্ভূত হবেন। সে লক্ষ্যেই যেন নিজেকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে চাইছেন তিনি।
এদিন সিলেটের পিচে এদিন ঘাস ছিল বেশ। শুরুর ধকল কাটিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা হয়েছে দুরন্ত। প্রায় প্রতিটা ব্যাটার নিজেদের হাত খুলে ব্যাটিং করেছেন। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি মুশফিকও। তিনি তাঁর শতকের ইনিংসে পৌঁছাতে ব্যাট করেছেন ১৬৬.৬৬ স্ট্রাইকরেটে। ১৪ টি চার ও ২টি ছক্কায় তিনি বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক। মাত্র ৬০ বলে তিনি ছুঁয়ে দেখেছেন শতরান।
এর আগে বাংলাদেশের হয়ে সাকিব আল হাসান ৬৩ বলে করেছিলেন শতক। গোটা দলই যেন রেকর্ড ভাঙা আর গড়ার মহা-উৎসবে মত্ত। গেল ম্যাচেই নিজেদের দলীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ভেঙেছিল বাংলাদেশ। ঠিক এক দিন বাদেই আবার সেই রেকর্ড মুছে মুশফিক লিখিয়েছেন নতুন রেকর্ড।
বেশ একটা জরাজীর্ণ পরিস্থিতি পার করে যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে নতুন এক সূর্যোদয়ের আশা জেগেছে। আর এই নবযাত্রায় মুশফিকুর রহিমদের এমন আগ্রাসী রুপই বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল সমর্থকদের ভরসা দেখায়। নিত্য-নতুন আশায় বুক বাঁধতে বাধ্য করে।