একগুয়ে, স্বেচ্ছাচারী, রাগী। চান্দিহা হাতুরুসিংহের পাশে এমন বেশ কয়েকটা নেতিবাচক বিশেষণ যোগ করাই যায়। কিন্তু সেসব অভিযোগ যেন ঠিক তীব্রতা পায় না। কারণ একটাই। হাতুরু বারবারই বাংলাদেশকে সাফল্যের ভেলায় ভাসিয়েছেন, ভাসাচ্ছেন । যা তিনি আগে ছিলেন, এখনও রয়েছেন।
অতীত কিংবা বর্তমান- বাংলাদেশের সাথে হাতুরুসিংহের যাত্রাটা সব সময়ই যেন রঙিন। ৬ বছর আগেও তিনি ছিলেন জয়ী, ৬ বছর পরে এসেও সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আবারো জয়ের সুবাতাস ছড়াতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে হাতুরুসিংহেই যেন সব মুশকিলের আসান। এই মাস খানেক আগেই দলের মধ্যে বিভাজতা, অন্তর্দলীয় কোন্দল নিয়ে কতশত বিতর্ক। কিন্তু হাতুরুর ছোঁয়ায় সব যেন উবে গেল মুহূর্তের মধ্যেই। সাফল্যের হাসিতে হাসলো বাংলাদেশ। এখন গোটা দলটাই যেন হঠাতই সুখী একটা পরিবার।
জাদুমন্ত্র কিংবা অজানা কোনো পন্থা, যেভাবেই হোক হাতুরুসিংহে জয়ের রেসিপিটা ভালই জানেন। তাঁর গড়া রণকৌশলে সম্ভবনার উঁকি দেখা গিয়েছিল আগের মেয়াদেই। সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটছে এবারও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পর আইরিশদের বিপক্ষে পূর্ণ আধিপত্য। প্রতিপক্ষের সাথে একটা অসম ব্যবধান তৈরি করা। সবটাই হচ্ছে হাতুরু আসার পর।
আয়ারল্যান্ডের সাথে বহু আগে থেকেই শক্তিমত্তায় এগিয়ে বাংলাদেশ। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে সেই প্রতিফলনটার দেখা মিলতো কমই। জয় আসতো নিয়মিতই, কিন্তু স্কোরকার্ডে সে সব ম্যাচে আইরিশরদের প্রতিরোধ গড়ার চিত্রটাও প্রতীয়মান হতো।
কিন্তু আয়ারল্যান্ডকে এবার সেই সুযোগই দেয়নি বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই বাংলাদেশ সাড়ে তিনশোর পথে হেঁটেছে৷ দ্বিতীয় ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলেও প্রথম ম্যাচে পেয়েছিল রেকর্ড গড়া জয়। প্রথম ম্যাচে রেকর্ড গড়া জয়, আর দ্বিতীয় ম্যাচে রেকর্ড গড়া সংগ্রহ। দুই রেকর্ডের বুনন বোনার নেপথ্যে ছিলেন চান্দিকা হাতুরুসিংহে।
মাস সাতেক পরেই ভারতে বসছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ভারতের উইকেট যে কতটা রানপ্রসবা, সেটা আগ বাড়িয়ে না বললেও চলে। শুধু ভারত নয়, এখন প্রতিটা দেশই ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে চায়। এমন ভাবনায় উন্নতির শিখরেও যায় তারা।
কিন্তু এখানেই যেন এতদিন ঢের পিছিয়ে ছিল টাইগাররা। স্রেফ একটা ম্যাচ জয়ের জন্য যতটা লক্ষ্য ছুঁড়ে দেওয়া প্রয়োজন তাতেই চোখ থাকতো বাংলাদেশের। কিন্তু আধিপত্য বিস্তার করে একটা জয় মানে যে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অন্য ম্যাচ জয়ের পথে স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাওয়া- সেই প্রসেসটারই অনুপস্থিতি ছিল এতদিন। হাতুরুর আগমনে কিংবা ড্রেসিংরুমে তার রণকৌশলে ভয়ডরহীন একটা ক্রিকেটের ছাপের দেখা মিলছে ইংল্যান্ড সিরিজ থেকেই। হাতুরুর সিলেবাসে যেন আক্রমণাত্বক ক্রিকেটই মূখ্য।
হ্যাঁ। সব সময় আক্রমণাত্মক মানসিকতায় সুফল আসবে না। কিন্তু বর্তমান ক্রিকেট যেভাবে বিবর্তিত হচ্ছে তাতে দুটো দলের মধ্যে ব্যবধানটা তৈরি করে ঐ আত্মবিশ্বাসী এপ্রোচই। বড় দলগুলো সাফল্যের শীর্ষে উঠেছে এই এক পন্থাতেই।
হাতুরুর রণকৌশলে বরাবরই তরুণদের প্রাধান্য থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নাম্বার তিনে শান্তকে ঠিক করেছেন। আর পাঁচে তাওহীদ হৃদয়কে। কারণ একটু গভীরভাবে ভাবলে, এই দুজনই আগামী ৫ বছর পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্তম্ভ হবেন ৷ এখন সেই ভিত্তিটা মজবুত করতে তরুণদের ফ্রি লাইসেন্স দেওয়া যে বড্ড প্রয়োজন। হাতুরুও তা দিয়েছেন। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার টোটকা দিয়েছেন। আর তাতে মিলছে সাফল্যও। শান্ত রান ফোয়ারার মাঝে আছেন৷ একইভাবে তাওহীদ হৃদয়ও রান করেছেন প্রবল আত্মবিশ্বাসে।
হৃদয়ের এমন ব্যাটিং পজিশনের কারণে মুশফিককে একটু নিচে নেমে যেতে হয়েছে ব্যাটিং অর্ডারে। ক্রিকেট ইতিহাসে এটা নতুন কিছু নয়। দলের প্রয়োজনে ধোনি, গাঙ্গুলিরাও এক সময় নিজেদের ব্যাটিং অর্ডারে ছাড় দিয়েছিলেন।
সেই একই যাত্রায় ৬ বছর পর আবারো ৬ নম্বরে ব্যাট হাতে উঠেছিলেন মুশফিক। আর পুরনো ব্যাটিং অর্ডারেই যেন এক নতুন মুশফিককে চিনলো বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে ২৪ বলে ৪৬, আর দ্বিতীয় ম্যাচে ৬০ বলে ১০০। কে বলবে, এই ব্যাটারই শেষ কয়েকটা সিরিজ ধরে রক্ষণাত্বক ক্রিকেটের জালে আটকা পড়ে ছিলেন। কিন্তু আয়ারল্যান্ড সিরিজেই দেখা মিলল আগ্রাসী মুশফিকের।
বুঝাই যাচ্ছে, দলের সবার প্রতি হাতুরুর বার্তা একদম স্পষ্ট, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে হবে। কোচের এমন চাওয়াতেই মূলত বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র আবারো প্রতীয়মান হচ্ছে। যেমনটা তাঁর প্রথম মেয়াদেও হয়েছিল। এবার নিশ্চয় হাতুরু ছাপিয়ে যেতে চাইবেন তাঁর প্রথম মেয়াদের সাফল্যকেও। ভয়ডরহীন ক্রিকেটের যে রেসিপিটা তিনি ক্রিকেটারদের মধ্যে পুরে দিচ্ছেন তাতে সেই সম্ভবনার পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন চান্দিকা হাতুরুসিংহে।