প্রিয় ১০ ইনিংস

প্রচলিত ঘরানার সাংবাদিক না হলেও নিজের দেখা ইনিংস গুলোর মাঝে সেরা ইনিংসগুলোর কথা লিখতে নিশ্চয়ই বাঁধা নেই। সেটাই একটু করার চেষ্টা করছি। সেরা না বলে ইনিংসগুলোকে ‘প্রিয়’ও বলা যায়। ওয়ানডে এবং টেস্টের বিভাজন বাদ দিয়ে সব মিলিয়েই লেখার চেষ্টা করলাম। স্মৃতি শক্তির উপর নির্ভর করে লিখলাম, কিছু হয়তো বাদ পড়ে গেলো।

  • ব্রায়ান লারার অপরাজিত ১৫৩, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া

আগের ১৩ টি সিরিজের মাঝে অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল মাত্র দু’টিতে, সেই দুটিও ভারতের মাটিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে কোন বিবেচনাতেই অস্ট্রেলিয়া ছিল ফেভারিট। প্রথম টেস্টে উইন্ডিজকে অল আউটও করে মাত্র ৫১ রানে। দ্বিতীয় টেস্টে লারার ২১৩ রানের সুবাধে জিতলেও তৃতীয় টেস্টে ৩০৮ রানের টার্গেটে মাত্র ১০৫ রানেই পাঁচ উইকেট হারিয়ে বিপদে উইন্ডিজ।

জিমি অ্যাডামসকে নিয়ে একটা জুটি গড়লেও ২৪৮ রানে অষ্টম উইকেট পড়ার পর যে কোন বিবেচনাতেই উইন্ডিজ ব্যাকফুটে। ম্যাকগ্রা তখন মাঠে আগুন জড়াচ্ছেন। কিন্তু শেষ দুই উইকেটে অ্যামব্রোস আর ওয়ালশকে সঙ্গী করে মাত্র এক উইকেটে জেতা সেই ম্যাচে লারার বীরত্ব লিখে শেষ করার মতো নয়। গত শতাব্দীর সেরা ইনিংসে এটার অবস্থান দুই নম্বরে।

  • ভিভিএস লক্ষণ ২৮১, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া

ব্রায়ান লারার ইনিংসের খুবই কাছাকাছি, হয়তো লারার চেয়েও সেরা। অস্ট্রেলিয়া তখন এসেছে ভারত জয় করতে। দল দূর্দান্ত ফর্মে। সম্ভবত আগের ১৫ টি টেস্ট জিতে ভারতে আসা হয়েছে। প্রথম টেস্ট জিতলো ১০ উইকেটের ব্যবধানে, ভারত পাত্তাই পায়নি। দ্বিতীয় টেস্টেও ভারতকে ফলো অনে ফেলে নিশ্চিন্তে জয়ের দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিল লক্ষন। ২৮১ রানের ইনিংসটা ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংস নিঃসন্দেহ, সর্বকালের সেরা বিবেচনাতেও প্রথম পাঁচ টার ভেতরে নিশ্চিন্তে জায়গা করে নিবে।

  • সনাৎ জয়াসুরিয়া ১৮৯, প্রতিপক্ষ ভারত

দলের টপ অর্ডার চারজন ব্যাটসম্যান সাজঘরে, রান রেট মাত্র ৪.১৭। ব্যক্তিগত ১০০ রান পূরণ করলেন মাত্র ১১০ বলে। দলীয় সংগ্রহ তখন ৩৬ ওভার ২ বলে মাত্র ১৬৭। একজন ব্যাটসম্যান যদি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ১০০ রান করার পরে আউট হয়ে যান, তাহলে সেই ব্যাটসম্যানকে সেই ম্যাচে অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে ব্যর্থ বলা যাবে না।

কিন্তু সেই সময়ে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, জয়াসুরিয়া যদি ১০০ রান করার সাথে সাথেও আউট হয়ে যেতেন, তাহলেও শ্রীলংকার ২০০ এর নীচে অল আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শেষ পর্যন্ত ৪৯ তম ওভারে যখন জয়া আউট হলেন তখন তার সংগ্রহ ১৮৯। ৫০ ওভার শেষে শ্রীলংকার রান গিয়ে দাঁড়ালো ২৯৯ এ। উইজডেন কর্তৃক নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসে এর অবস্থান তিন নম্বরে।

  • স্টিভ ওয়াহ অপরাজিত ১২০ রান, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা

টার্গেট ২৭২, তবে সেটা কাগজে কলমে। সেই সময়ে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে রান তাড়া করার সময় মাথায় অতিরিক্ত ৩০/৩৫ রান যোগ করে নিতে হতো, কারণ সবাই জানতো যে ফিল্ডিং এ অন্তত এই রানটা আফ্রিকা সেইভ করবেই। ১২ তম ওভারে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন ডেমিয়েন মার্টিন আউট হলেন তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৩৮.৩ ওভারে ২২৪ রান।

বাচা মরার সেই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত স্টিভ করেছিলেন অপরাজিত ১২০ যা কিনা অস্ট্রেলিয়াকে সেমিতে পৌছে দেয়। সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার কথা সবাই জানে। কিন্তু এই ইনিংসটা না হলে অস্ট্রেলিয়ার জায়গায় সর্বজয়ী দলে হয়তো আমরা এখন দক্ষিন আফ্রিকাকে দেখতে পেতাম।

  • আজহার মেহমুদ ১৩৬, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা

১১২ রানে পঞ্চম উইকেট পড়ার পর মাঠে নেমেছিলেন আজহার। দক্ষিন আফ্রিকান বোলাররা তখন মাঠে আগুন জড়াচ্ছেন। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরকে নিয়ে খেললেন ১৩৬ রানের একটা ইনিংস। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হলেন তখন দলের সংগ্রহ ৩২৯। নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচটা ড্র করলো পাকিস্তান। গত শতাব্দীর সেরা ইনিংসের তালিকায় এর অবস্থান আট নম্বরে।

  • সাঈদ আনোয়ার ১৮৮, প্রতিপক্ষ ভারত

ইনিংসটাতে জাভাগাল শ্রীনাথ পেয়েছিলেন ৮ উইকেট। কিছু কিছু দিন থাকে যেদিন বোলার যেমনটা করতে চান ঠিক তেমনটাই করতে পারেন। সেরকম একটা দিন গিয়েছিল শ্রীনাথের। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে সাঈদ আনোয়ারও প্রতিরোধ বজায় রেখেছিলেন। শেষের ৫ জন ব্যাটসম্যান মিলে করতে পেরেছিল মাত্র ১৯ রান। ম্যাচটা পাকিস্তান জিতে মাত্র ৪৬ রানে। যৌথ ভাবে ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কার পান শ্রীনাথ এবং সাঈদ আনোয়ার।

  • শচীন টেন্ডুলকার ১৩৬, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান

টার্গেট ছিল ২০০ ওভারে ২৭১। কিন্তু মাত্র ৮৯ রানেই শেষ ভারতের প্রথম ৫ উইকেট। মঙ্গিয়াকে নিয়ে জুটি গড়ে ভারতকে ম্যাচে ফেরত নিয়ে আসলো শচীনই। হয়তো জিতিয়েই ফিরতো। কিন্তু পিঠে ব্যাথার কারণে একটু দ্রুত ম্যাচ শেষ করতে চাইলেন হয়তো লিটল মাস্টার। এজন্য সাকলাইন মুস্তাককে এক ওভারেই দুটো চার মেরেও আরেকটা চার মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন শচীন। দলের রান তখন বাকি মাত্র ১৭। কিন্তু শেষ ৩ উইকেট ফেলে দিলেন মাত্র ৪ রানেই ওয়াসিম এবং সাকলাইন। হেরে গেলেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেলেন শচীনই।

  • ইনজামাম উল হক ৬০, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড

যখন মাঠে নামলেন তখন প্রয়োজন আরো ১২৮ রান, ওভার বাকি ছিল সম্ভবত ১৫ টি। ১৯৯২ সালে ওভারপ্রতি ৮ এর উপর রান করা অসম্ভবেরই নামান্তর। এর উপর প্রতিপক্ষ ছিল সিরিজে দূর্দান্ত খেলতে থাকা নিউজিল্যন্ড। কিন্তু ৩৭ বলে ৬০ রানের একটা ইনিংস খেলে ম্যাচটা পাকিস্তানের হাতে তুলে দিল ইনজি। ইনজির ইনিংসের কারণেই সেমিতে জয় পেল পাকিস্তান।

  • মোহাম্মদ আশরাফুল ১০০, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া

ছোট দলের জন্য বড় দলকে হারানোর কিছু ফর্মূলা আছে। আগে ব্যাটিং করে মোটামুটি একটা সংগ্রহ দাড় করানো, তার পর বোলিং এ প্রথমদিকেই দুই একটা উইকেট ফেলে বিপক্ষে দলকে চাপে ফেলে দেওয়া। এরপর শেষ পর্যন্ত চাপটা ধরে রাখা। আপসেটের প্রথম দশটা ম্যাচের একমাত্র এই ম্যাচটাই চেজ করে জেতানো।

আশরাফুল সেদিন ছিলেন যেন অন্য গ্রহের একজন মানুষ। সেই অস্ট্রেলিয়া ছিল সর্বজয়ী একটা দল, আর বাংলাদেশ ছিল অনেক পেছনে থাকা দল। সেই সময়ের পর বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, একই সাথে অস্ট্রেলিয়ারও অনেক পতন হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এরপর কখনোই বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি।

ম্যাচটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ পাচটি ওয়ানডে ম্যাচের তালিকায় এই ম্যাচটা নাম ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেরা ম্যাচের পুরষ্কার জিততে পারেনি। সেটা জিতেছিল অষ্ট্রেলিয়া বনাম সাউথ আফ্রিকার বিশ্বকাপের টাই ম্যাচটা। তবে সেরা হতে না পারলেও সেরা পাচে থাকাটাও নিশ্চয়ই অসাধারণ কিছু।

  • আকরাম খান ৬৮*, প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড

ম্যাচটা নিজের চোখে দেখিনি, রেডিওতে শোনা। তারউপর কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচও নয়। তবুও সেরার বিবেচনায় আসার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে ইনিংসটার অবদান অনেক।

ম্যাচ শুরুর আগে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশই ফেভারিট ছিল। টস জিতে বাংলাদেশ ফিল্ডিং নেয়, ৪৯.৫ ওভারে ১৭১ রান করে অল আউট হয় নেদারল্যান্ড। ৫০ ওভারে টার্গেট মাত্র ১৭২ রান। হাসতে হাসতেই ম্যাচটা জেতার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু ম্যাচের ৩য় ওভারের মাঝেই প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যান (নাইমুর রহমান, সানোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম) মাত্র ১৩ রানে সাজঘরে ফিরে যাওয়ায় আকরাম খানকে নামতে হয় ক্রিজে। পরের ওভারে আতাহার আলি আউট হলে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ১৫।এই মূহুর্তে শুরু হলো বৃষ্টি। ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড অনুযায়ী ২০ ওভারে মাত্র ৩৭ রান করলেই বাংলাদেশ জিতে যেত, তবে সেই শর্তটা পূরণ হতো, যদি কোনো উইকেট না হারাতো। ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ায় সেই টার্গেট হয়ে গেল ৭৭। বৃষ্টির আগে বাংলাদেশ করেছিল ১৮.৫ ওভারে ৫৬ রান, তার মানে, বাকি ১৪.১ ওভারে করতে হবে ৮৫ রান। ৮৫ বলে ৮৫। সেখান থেকে অপরাজিত ৬৮ রান করে ম্যাচটা বের করে নিয়ে আসলেন আকরাম খান।

ম্যাচটা না জিতলে বাংলাদেশ ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপ খেলতে পারে না, আর খেলতে না পারলে পাকিস্তানকে হারাতে পারে না। এত দ্রুত টেস্ট স্ট্যাটাসও আর পাওয়া হয় না। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাই এই ইনিংসের গুরুত্ব বলে বোঝানো যাবে না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link