চিকিৎসকের সাদা অ্যাপ্রোন আর টেস্ট ক্রিকেটারের সাদা পোশাক- দুটোই গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য খুব বেশি মানুষের না হলেও একেবারে যে কারও হয়নি তা নয়। ক্রিকেটের সবচাইতে বর্ণিল চরিত্রদের একজন ডব্লিউ জি গ্রেস ক্রিকেটারের পাশাপাশি ছিলেন একজন চিকিৎসক। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার আলী ব্যাখার, নিউজিল্যান্ডের ক্রিস হ্যারিস বা অস্ট্রেলিয়ার জিওফ লসনও কোনো না কোনো সময় এর সাথে জড়িত ছিলেন। তবে আজ এমন একজন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক-ক্রিকেটারকে নিয়ে লিখছি, যিনি সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারগুলোর একটির মালিক, কিন্তু সম্ভবত তার চাইতে বেশি দুর্ভাগা তার সহধর্মিনী।
মূল ঘটনায় যাবার আগে ডাক্তার সাহেবের পরিচয়টা ছোট্ট করে জেনে নেয়া যাক। পুরো নাম৷ রয় লিন্ডসে পার্ক। তাকে অলরাউন্ডার বললে ভুল হবে না একদমই, কেননা তিনি একাধারে ছিলেন ফুটবলার, ক্রিকেটার ও চিকিৎসক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশ বছর বয়সী পার্কের অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়া ফুটবল লিগে। প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত, ২২ গোল নিয়ে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন সেবার। পরের মৌসুমে নিজের নৈপুণ্যকে আরেক ধাপ উন্নীত করেন পার্ক, মৌসুমে বল জালে জড়ান ৫৩ বার। দ্য অস্ট্রালেশিয়ান পত্রিকা অনুযায়ী, তার ফুটবলীয় নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে এমনকি একবার বিপক্ষ দলের সমর্থকেরা তাকে কাঁধে তুলেছিলো। সেই ম্যাচে পাঁচ গোল করেছিলেন তিনি।
এরপরের মৌসুমে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় খুব বেশি ম্যাচ খেলবার সুযোগ না হলেও করেছিলেন ৩৬ গোল।
পরবর্তী মৌসুমেও স্বরূপেই ছিলেন পার্ক, ইতোমধ্যে ১৩ ম্যাচে করে ফেলেছিলেন ৩৫ গোল। কিন্তু বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী তার পক্ষে সাক্ষ্য দিলেও চার ম্যাচের জন্য তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে আর খেলতে রাজি হননি পার্ক, ফলে তার ভিক্টোরিয়া ফুটবল লিগ ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে এখানেই।
ফুটবলের কথা বলতে বলতে ক্রিকেটের কথা বলাই হয়নি। কলেজজীবন থেকে পার্ককে একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার হিসেবে গণ্য করা হতো। ভিক্টোরিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে তিনি খেলতেন সাউথ মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। ক্লাবের হয়ে উদ্বোধনী জুটিতে একবার বিল উডফুলের সঙ্গে গড়েছিলেন ৩১৫ রানের জুটি, যা দীর্ঘদিন ছিল ক্লাবের রেকর্ড। বিল উডফুলের নামটা পরিচিত লাগার কথা। বিখ্যাত, অথবা কুখ্যাত, বডিলাইন সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার দলপতি ছিলেন তিনি।
ব্যাট হাতে ভালো করার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯১৪-১৫ মৌসুমের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পান পার্ক।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেটে চলে যায় সিরিজটা। পার্কও দেশের ডাকে যুদ্ধে যোগ দেন চিকিৎসক হিসেবে। সেখানে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় নিরাপদে ফিরে আসেন তিনি।
যুদ্ধের পর ফুটস্ক্রেতে মেডিক্যাল প্র্যাকটিস করছিলেন পার্ক। স্থানীয় ফুটবল ক্লাবের হয়ে মাঠে নামার মাধ্যমে আবারও ফুটবলে ফেরেন তিনি। ১৯২০ সালে ভিক্টোরিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নর্থ মেলবোর্নের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হওয়ার দশ সেকেন্ডেরও কম সময় বাকি থাকতে বল জালে জড়িয়ে দলকে জেতান রয় পার্ক।
এদিকে ভিক্টোরিয়াতে ব্যাট হাতে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলে ডাক পান। অধিনায়ক ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের ‘গুডবুকে’ আগে থেকেই ছিলেন তিনি। প্রায়ই তাদের একসঙ্গে দেখা যেতো। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার পার্ক যদি তখনকার সবচাইতে স্থুলকায় ক্রিকেটার আর্মস্ট্রং ‘দ্য বিগ শিপ’ এর সঙ্গে ঘোরেন, তবে তা তো মানুষের চোখে পড়বেই।
যাহোক, অভিষেকের আগের রাতে নাকি উত্তেজনায় অনেকের ঘুম হয় না। পার্কেরও ঘুম হয়নি, তবে তা অন্য কারণে। রাতের বেলা ডাক্তারসাহেবের ডাক পড়লো জরুরি পরিস্থিতে চিকিৎসা সেবা দেবার জন্যে।
সকালবেলা টস জিতে ব্যাটিং নিলেন আর্মস্ট্রং। হার্বি কলিন্স আর ওয়ারেন বার্ডস্লি পৌনে দু’ঘন্টায় যোগ করলেন ১১৬ রান। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এরপর সাজঘরে ফিরলেন কলিন্স, হন্তারক অভিষিক্ত হ্যারি হাওয়েল।
মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে মাঠে প্রবেশ করলেন ডাক্তার রয় পার্ক। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মুহূর্তটা ছয় বছর আগেও আসতে পারতো। যা হোক, ‘বেটার লেইট দ্যান নেভার’।
অভিষিক্ত হাওয়েল প্রস্তুত হচ্ছেন আরেক অভিষিক্ত পার্কের বিপক্ষে বল করতে। মিসেস পার্ক, অর্থাৎ আমাদের রয় পার্কের স্ত্রী অতি অবশ্যই উপস্থিত ছিলেন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। সময় কাটানোর জন্যে সুঁই-সুতো নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তখন তো আর স্মার্টফোন ছিলো না!
এতক্ষণ বুনুনির কাজ করছিলেন মিসেস পার্ক। কথিত আছে, হাওয়েল যখন বল করতে তৈরি, তখন হঠাৎ মিসেস পার্কের সুতোর বলটা নিচে পড়ে গেলো। তিনি এটা তুলে মাথা উঁচু করেই দেখতে পান তার স্বামী ততক্ষণে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন।
মজার এবং একই সঙ্গে দু:খের ব্যাপার হলো, রয় পার্ক আর কখনোই টেস্ট খেলতে পারেন নি। মিসেস পার্ক তাই পড়ে যাওয়া সুতোর বলটা তুলতে গিয়ে স্বামীর পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারটা মিস করে ফেলেছিলেন।
সঙ্গত কারণেই বলছিলাম যে, মিসেস পার্ক সম্ভবত আমাদের ডাক্তার সাহেবের চাইতেও বেশি অভাগা।
এতক্ষণে আপনি যদি ভাবতে শুরু করেন যে, রয় পার্ক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সবচাইতে দুর্ভাগা ক্রিকেটার, তবে তাতে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন ডাচ ক্রিকেটার জেল্টে শুনহেইম। ২০০৮ সালে বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে একাদশে ছিলেন তিনি। দুই অধিনায়ক মাঠে নেমে টস করতে পারলেও বৃষ্টির জন্যে মাঠে আর খেলা গড়ায়নি। টস হয়ে যাওয়ায় ম্যাচটা রেকর্ডবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার মানে, নামের পাশে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ থাকলেও তার ক্যারিয়ারের স্থায়িত্ব ছিল তিন ঘন্টা, অর্থাৎ অধিনায়কদের টস করা থেকে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়া পর্যন্ত।