একটা সময় ট্রেন এবং কিটব্যাগই ছিল তাঁর জীবন। পালগড় নামের ছোট্ট এক শহর থেকে প্রতিদিন ৮৭ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে মুম্বাইতে আসতেন ক্রিকেট শেখার নেশায়। যেতে আসতেই কেটে যেত সাত ঘন্টা, তবু কখনো হাল ছাড়েননি। নিজের একাগ্রতা এবং পরিশ্রম দিয়ে মিডিওকোর ক্রিকেটার থেকে ক্রমেই বনে গেছেন স্মার্ট ক্রিকেটার। ভক্তরা তাঁকে উপহাস করে ডাকতো “লর্ড ঠাকুর” নামে, সময়ের পরিক্রমায় যেন শার্দুল ঠাকুর যেন সত্যিকার অর্থেই ভারতীয় ক্রিকেটের লর্ড হয়ে উঠেছেন।
স্কুল ক্রিকেটে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে আবির্ভাব শার্দুলের। স্বামী বিবেকানন্দ স্কুলের হয়ে হ্যারিস শিল্ডে এই কীর্তি গড়েন তিনি। সেই ম্যাচের পারফরম্যান্সই তাঁকে জায়গা করে দেয় মুম্বাইয়ের বয়সভিত্তিক দলে। যদিও সে সময়ে তাঁর পরিচিত ছিল মূলত পেসার হিসেবেই যিনি কিনা অল্পসল্প ব্যাট চালাতে জানেন।
২০১২-১৩ মৌসুমে রঞ্জিজয়ী মুম্বাই দলে থাকলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ তেমন পাননি। শার্দুল বুঝলেন প্রতিভাবান সব তারকাদের ভীড়ে টিকে থাকতে হলে তাঁর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তিনি লেগে থাকলেন, পরের মৌসুমগুলোতে ক্রমশই শাণিত করে তুললেন নিজেকে। পরের দুই মৌসুমে ৭৪ উইকেট শিকারের পর তাঁকে আর উপেক্ষা করাই গেল না।
কিন্তু টেস্ট অভিষেকটা বোধহয় ভুলেই যেতে চাইবেন শার্দুল! মাত্র দশ বল করার পরই ইনজুরির শিকার হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ ছাড়েন। তাছাড়া নিজের ওজন নিয়েও সমালোচিত হচ্ছিলেন তিনি। আইপিএলে দল পেলেও মাঠে নামার সুযোগ পাচ্ছিলেন না, সময়টা কাটছিল সাইড বেঞ্চেই। সবাই ভেবেছিলেন সীমিত সামর্থ্যের এই তারকা বোধহয় হারিয়েই যাবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শার্দুল ফিরে আসেন প্রবলভাবে।
পাঞ্জাব কিংস, রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টস হয়ে চেন্নাইতে মহেন্দ্র সিং ধোনির অধীনে প্রথমবারের মতো নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পান এই তারকা। দলটির হয়ে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমেই তুলে নেন ২১ উইকেট।
জাতীয় দলের নেট বোলার হিসেবে উড়াল দেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু বাকিদের ইনজুরির সুবাদে গ্যাবাতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুযোগ পেয়ে যান একাদশেই। এবারে আর সুযোগটা হেলায় হারাননি, ব্যাট হাতে ৬৭ রান করার পাশাপাশি তুলে নেন সাত উইকেট। এরপর আর ফিরে তাকানো হয়, স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারেই ভারতকে জয় এনে দিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। জোহানেসবার্গ, ব্রিসবেন, দ্য ওভাল কিংবা নটিংহ্যামশায়ার, সবখানেই শার্দুল ঠাকুর ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
ছোটবেলায় আক্রমণাত্নক ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম ছিল। কিন্তু জাতীয় দল কিংবা আইপিএল কোথাও ব্যাটসম্যান হিসেবে সুযোগ মেলেনি তাঁর। তবে এবারের আইপিএলে তাঁর নতুন ঠিকানা কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ব্যাট হাতে নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। দিল্লি থেকে বড় আশা নিয়েই তাঁকে দলে ভেড়ায় দলটি, সেই আস্থার প্রতিদান কি দারুণভাবেই না দিলেন এই তারকা। ঘরের মাঠে ৮৯ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে কলকাতা যখন ধুঁকছে, তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভার তাঁর। পরের মিনিট চল্লিশে ব্যাঙ্গালুরুর বোলারদের উপর দিয়ে যেন ঝড় বইয়ে দিলেন। ২১ বলে ৬৮ রানের মারকাটারি এক ইনিংস খেলে যখন সাজঘরে ফিরছেন ততক্ষণে দল পেয়ে গেছেন দুশো ছাড়ানো সংগ্রহ। পরে বল হাতেও তুলে নিয়েছেন এক উইকেট।
শচীন টেন্ডুলকারের সাথে জার্সি নম্বর মেলায় একসময় ট্রলের শিকার হয়েছেন, হাসাহাসি করে সবাই ডাকতেন লর্ড নামে। তবে সবকিছুর জবাবটা মাঠেই দিয়েছেন শার্দুল। কলকাতার দর্শকরা কাল বিরাট কোহলির জন্য গলা ফাটাননি, চিৎকার করেননি শাহরুখ খান কিংবা আন্দ্রে রাসেলের জন্যে, বরং ইডেন গার্ডেন্স যেন হয়ে উঠেছিল শার্দুল ঠাকুরের গুণমুগ্ধ ভক্ত।