সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি বহুবার। কখনো ফরম্যাটে ভেদে তাঁর ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ দিয়ে, আবার কখনো অতি উদযাপনে। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের ক্রিকেট মহল গরম করেছেন নিজের বিতর্কিত মন্তব্যে। তবুও এসব কিছু ছাপিয়ে মুশফিকুর রহিম মাঠের পারফরমেন্স দিয়ে থেকেছেন সবচেয়ে বেশি আলোচনায়।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সাত হাজার রানের মালিক তিনি। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় ১৩ হাজারের উপর রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। একজন ব্যাটার ক্রমাগত ব্যাটে রান পেয়েছেন। ক্যারিয়ার জুড়েই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন বহুবার। ক্যারিয়ারের প্রায় শেষের দিকে। এমন সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত এক পদক্ষেপই নিয়েছেন তিনি।
একটি ফরম্যাটকে বিদায় জানিয়েছেন। আর সেটার সুফল যেন পেতে শুরু করেছেন হাতে নাতে। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড সিরিজ থেকেই যেন প্রত্যাবর্তনের নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছেন মুশফিক। খানিকটা মলিনতা ছুঁয়ে যাওয়া মাস্টার ব্যাটারের ক্যারিয়ারে যেন এসেছে আবার উজ্জ্বলতা। মুশফিকের ব্যাট হাসতে শুরু করেছে নিয়ম করে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে তিনি পেয়েছেন সেঞ্চুরির দেখা। চার ইনিংসের ব্যবধানে আরও একবার তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার। তবে সময়ের ব্যবধানটা প্রায় এক বছরের। এই দীর্ঘ বিরতির পর শতক পেয়েই ক্ষান্ত হয়ে যাননি মুশফিক। দ্বিতীয় ইনিংসে আইরিশদের বিপক্ষে তুলে নিয়েছেন হাফ সেঞ্চুরি। দলকে নিয়ে গেছেন জয়ের বন্দরে।
ধারাবাহিকতার আরও একটি উদাহরণ হয়ত তিনি রেখে যেতে চাইছেন। তবে মুশফিকের এই নবজাগরণে আরও একটি বিষয় নজরে এসেছে। তিনি আর নেই সেই ধীর গতির মুশফিকুর রহিম। বরং তিনি এখন বলের মেরিট বুঝে খেলার চেষ্টা করেন। বিন্দুমাত্র এদিক-সেদিক হওয়া মাত্রই তিনি বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে দ্বিধা করেন না। তাছাড়া ডট খেলার প্রবণতাতেও পড়েছে ভাটা। স্ট্রাইক রোটেশনেও মনোযোগ বাড়িয়েছেন মুশফিকুর রহিম।
অবশ্য এক্ষেত্রে কোচ চাণ্ডিকা হাতুরুসিংহের প্রভাবটাও স্পষ্ট। তিনি চাইছেন তাঁর দলের প্রতিটা খেলোয়াড় আগ্রাসী ক্রিকেটটা খেলুক। মুশফিক সেই ধাচে খেলার প্রচেষ্টা চালিয়ে শতভাগ সফলই বলা চলে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১২৬ রানে তিনি থেমেছেন। এই সময়ে প্রায় ৭৬ স্ট্রাইকরেটে তিনি ব্যাটিং করেছেন। টেস্ট ও মুশফিকের পূর্ববর্তী রেকর্ড বিবেচনায় এই ইনিংসটি দ্রুতগতিরই বলা চলে।
দ্বিতীয় ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরির পথে তিনি ১০০ এর বেশি স্ট্রাইকরেটে ব্যাট চালিয়েছেন। দ্রুত খেলা শেষ করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই দ্রুতগতির আগ্রাসী ইনিংস খেলতে গিয়ে, অহরহ ভুলের দেখা মিলছে না মুশফিকের কাছ থেকে। বরং তিনি যেন আরও বেশি সতর্ক। নিজের পছন্দে সুইপ আর রিভার্স সুইপ শটগুলো তিনি খেলছেন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সাথে।
অন্যদিকে ওয়ানডেতে এই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬ ইনিংস পর শতকের দেখা পেয়েছেন মুশফিক। মাঝে আবারও সময়ের ব্যবধান বেশ বড়। প্রায় বছর দুই। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান নিজের পুরনো এক মন্তব্য আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম ২০২৩ সালটা আমাদের ভাল যাবে’।
২০২৩ সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের জন্যে ভাল যাচ্ছে। বিশেষ করে মুশফিকুর রহিমের জন্যে। সবার ধারণা ছিল হাতুরুসিংহে আসার পর সিনিয়র ক্রিকেটারদের সাথে তাঁর মনমালিন্য হতে পারে। তবে ঘটছে ঠিক উল্টোটা। তাঁর অধীনে সিনিয়র থেকে শুরু করে জুনিয়র ক্রিকেটার সবাই যেন অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রতিযোগিতা।
সেই প্রতিযোগিতায় বাড়তি প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহিমের। নিজের চিরায়ত খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছেন। আগ্রাসনকে নিজের সঙ্গী করেছেন তিনি। সফলতা এসে ধরা দিচ্ছে হাতে থাকা একফালি কাঠের টুকরোতে। নানান অভিযোগ থাকলেও ব্যাটার মুশফিককে নিয়ে অভিযোগ করবার সুযোগ নেই। দিনশেষে তিনি যখন তুলে রাখবেন নিজের ব্যাট-প্যাড, তখন তাঁর নামের পাশে যুক্ত হবে কিংবদন্তি। সেটাই তো অবধারিত।