বাইশ গজের ক্রিকেটে কত কীর্তিই তো হয়। আর সেই কীর্তিগুলোর ‘প্রথম’ কীর্তিমানের জন্য ইতিহাসে সব সময়ই আলাদা আসন থাকে। এমনই এক অনন্য কীর্তির মালিক বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট ইতিহাসে সাকিবই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যাটার যিনি টানা ৪ বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি করেছেন।
যে কীর্তির শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেবারের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। পোর্ট অব স্পেনে হওয়া সে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের বোলাররাই। মাশরাফি, আব্দুর রাজ্জাক ও মোহাম্মদ রফিকদের বোলিং তোপে ১৯১ রানেই গুড়িয়ে যায় ভারতের ইনিংস।
সেদিন বল হাতে সাকিব ছিলেন উইকেট শূন্য। তবে নিজের প্রতাপটা দেখিয়েছিলেন ব্যাটে। ১৯২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৭৯ রানেই ৩ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
দলের এমন বিপর্যয়ে মুশফিকুর রহিমের সাথে সেদিন ৮৪ জুটি গড়েছিলেন সাকিব। আর এরই মধ্যে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচেই প্রথম হাফসেঞ্চুরির দেখা পান এ অলরাউন্ডার।
৫ চার আর ১ ছক্কায় ৮৬ বলে ৫৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত যদিও স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হয়ে ফিরেছিলেন। তবে দল ততক্ষণে জয়ের ঠিকই দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। ৫ উইকেটে জয় পায় বাংলাদেশ।
২০১১ সালের বিশ্বকাপে স্বাগতিক দল হিসেবেই অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ আর ভারত। সেবার বাংলাদেশ দল সামলানোর দায়িত্ব যায় সাকিবের কাঁধে। তবে আগের বারের মতো এবার আর বাংলাদেশ বোলিংয়ে সুবিধা গড়তে পারেনি। বীরেন্দ্র শেবাগের ব্যাটিং তাণ্ডবে আর কোহলির সেঞ্চুরিতে ৩৭৫ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ভারত।
ভারতের দেওয়া এমন পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা ভালই করেছিল বাংলাদেশ। তবে বড় রানের চাপ শেষ পর্যন্ত জয় করতে পারেনি টাইগাররা।
শেষ পর্যন্ত ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৮৩ রান করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। তবে আগের বারের মতো এবারের বিশ্বকাপেও প্রথম ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি পান সাকিব। ৫০ বলে ৫৫ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। অবশ্য টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে সে ম্যাচের শুরুটা খুব বেশি ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ।
১০২ রানেই টপ অর্ডারের তিনজন ব্যাটার প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। এরপর উইকেটে আসেন সাকিব আল হাসান। রিয়াদের সাথে জুটি গড়েন।
তবে কিছুক্ষণ বাদে রিয়াদও ফিরে যান। এরপর মুশফিকের ১১৪ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন সাকিব। সেদিন সাকিব তাঁর ইনিংস সাজান ৫১ বলে ৬৩ রানে। সাকিবের টানা তিন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ফিফটির দিনে জিতেছিল বাংলাদেশই।
বাংলাদেশের দেওয়া ২৬৮ রানের লক্ষ্যে টাইগারদের বোলিং তোপে মাত্র ১৬২ রানেই অলআউট হয়ে যায় আফগানরা। ফলত, ১০৫ রানের জয় নিয়ে সেবারের বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপটা বলতে গেলে এক প্রকার ‘সাকিবময়’ই ছিল। ঐ এক বিশ্বকাপ দিয়েই সাকিব নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। ব্যাটিং কি বোলিং, দুই খানেই সাকিব দেখিয়েছিলেন সমান আধিপত্য। তবে সেবারের বিশ্বকাপে বিশ্ব ব্যাটার সাকিবকে নতুন করে চিনেছিল। ২ সেঞ্চুরি আর ৬ ফিফটিতে সেবার ৬০৬ রান করেছিলেন সাকিব।
সেবারের বিশ্বকাপের সাকিবের এমন অবিশ্বাস্য পারফর্ম্যান্সের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। ইনিংসের শুরুটা ভালই করেছিলেন বাংলাদেশের দুই উদ্বোধনী ব্যাটার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার।
তবে দলীয় ৭৫ রানের মধ্যেই এ দুই ব্যাটার ফিরে গেলে কিছুটা চাপে পড়ে বাংলাদেশ। তবে উদ্ভুত সেই চাপ দীর্ঘায়িত করতে দেননি সাকিব। মুশফিকের সাথে জুটি গড়ে দলকে এনে দেন দারুণ এক ভিত্তি। মিস্টার সেভেনটি ফাইভ তার জার্সি নাম্বারের সাথে মিলিয়ে খেলেন ৭৫ রানে ইনিংস।
আর এতেই নতুন এক কীর্তিতে নাম লেখান তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটার হিসেবে টানা চার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ফিফটির কীর্তি গড়েন তিনি।
সাকিবের এমন কীর্তি অর্জনের দিনে ম্যাচটাও জিতেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দেয়া ৩৩১ রানের লক্ষ্য শেষমেশ ছুঁতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩০৯ রানেই শেষ হয় তাদের ইনিংস।
বিশ্বকাপের কীর্তিতে সাকিবের অর্জনের তালিকাটা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপে ৯০০ রানের সঙ্গে ২৫ উইকেট নিতে নেওয়ার কীর্তি রয়েছে মাত্র তিনজনের। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ওয়াহ, শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়ার পর এ কীর্তিতে নাম লিখিয়েছেন সাকিবও।
তবে আরেকটি মানদণ্ডে বিশ্বকাপে ১০০০ রান ও ৩০ উইকেট নিতে পারেননি আর কেউ, শুধু ঐ সাকিব ছাড়া। সাকিব যে এখানেই অনন্য। যে কীর্তিতে তিনি প্রথম এবং তিনিই একমাত্র। নামটা ‘সাকিব’ বলেই এত সব রেকর্ডের মায়ায় জড়ানো সম্ভব।